ভুয়া দলিলের ফ্ল্যাট মর্টগেজে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ভুয়া দলিলের ফ্ল্যাট মর্টগেজে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ

নিজের একটি ফ্ল্যাট কিংবা এক টুকরো জমির স্বপ্ন অসংখ্য মানুষের। সেই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় এনে দেওয়ার কথা বলে অনেককেই লোভনীয় ফাঁদে ফেলছে একটি চক্র। চক্রটি কমদামে ফ্ল্যাট ক্রয়ের লোভ দেখিয়ে ক্রেতার কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিচ্ছে। এরপর ফ্ল্যাটের মালিকানার ভুয়া দলিলপত্র করে দিচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ফ্ল্যাটক্রয়ের এসব ভুয়া দলিলের বিপরীতে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। এরপর ফ্ল্যাট ক্রয়ের আর ঋণের অর্থ পুরোটাই আত্মসাৎ করে চলে যাচ্ছে আত্মগোপনে। এসব ভুয়া দলিলপত্র তৈরি এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যোগসাজশ রয়েছে সংশ্লিষ্ট অফিসের কতিপয় কর্মচারীসহ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তারও। আর এ চক্রের প্রধান হোতার নাম জয়নাল আবেদিন ইদ্রিস। অপকর্মের জন্য তার রয়েছে একাধিক এনআইডি।

জানা গেছে, প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে ভুক্তভোগীদেরও কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েছেন চক্রটির সঙ্গে। প্রতারণা করতে নীড় এস্টেট, স্নেহা এন্টারপ্রাইজ ও ই-আর ইন্টারন্যাশনালসহ চক্রের রয়েছে এক ডজন কাগুজে প্রতিষ্ঠান।

ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ প্রতারণা চক্রে নাম উঠে এসেছে অন্তত ২৫ জনের। চক্রটির বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আমাদের সময়ের অনুসন্ধান ও সিআইডির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ফ্ল্যাটের জাল দলিলপত্র তৈরি করেন জয়নাল আবেদিন ইদ্রিস। ফ্ল্যাটের জাল দলিল দিয়ে চক্রের সদস্যদের নামে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকার লোন নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন তিনি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাটের জাল দলিল দিয়ে পাঁচটি ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। চক্রের এক ব্যক্তির নামেই ১০ কোটি টাকার লোন নিয়েছেন তিনি। চক্রে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার অনেকের নাম রয়েছে যাদের যোগসাজশে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

এদিকে গত এক সপ্তাহে জয়নাল আবেদিনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেছে, সেগুলো ভুয়া। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেওয়া তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ। ফলে অভিযোগের ব্যাপারে তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

জানা গেছে, নীড় এস্টেট প্রোপার্টিজের নামে মেঘনা ব্যাংকের উত্তরা শাখায় ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। পরবর্তীতে আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৫০ লাখ টাকার ঢাকা ব্যাংকের একটি চেক (নম্বর ১২২০৭৮৯) ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে হিসাবটিতে জমা করা হয়। আইপিডিসি ফাইন্যান্স থেকে তারেক আজিজ নামের এক ব্যক্তিকে ফ্ল্যাট কেনার জন্য নীড় এস্টেটকে এই চেকটি ইস্যু করা হয়। হিসাবটির দলিলাদি বিশ্লেষণে সন্দেহ হওয়ায় রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মসে (আররো এসনি) মালিকানার তথ্য যাচাইয়ের জন্য আবেদন করলে প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া বলে জানা যায়। মূলত নীড় এস্টেটের ব্যবহার করা নিবন্ধন নম্বরটি এস্টেট এক্সপ্রেস বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই কাগুজে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জয়নাল আবেদিন। তিনি নীড় এস্টেটের মতো স্নেহা এন্টারপ্রাইজ এবং ইআর ইন্টারন্যাশনালসহ অর্ধডজন কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মিরপুরে দারুস সালাম রোডে রুমানা জুয়েলার্স নামে তার একটি স্বর্ণের দোকান রয়েছে। প্রতারণার জন্য তিনি নিজের একাধিক এনআইডি তৈরি করেছেন। ঢাকার মিরপুর ও খিলক্ষেতে তার একাধিক বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।

সিআইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জয়নাল আবেদিন ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকার মানিলন্ডারিং করেছেন। ফ্ল্যাটের ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ব্যাংকের লোন নিতে ওয়ান ব্যাংকের পল্টন শাখার লোন ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ যে কোনো ব্যাংকের ভুয়া কাগজপত্র এবং ব্যাংকিং সংক্রান্ত সব তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন।

গতকাল সন্ধ্যায় আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমি ওয়ান ব্যাংকে চাকরি করতাম। তবে কখনো পল্টনে ছিলাম না। জয়নাল আবেদিনকে চেনেন কিনা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, আমি ওভাবে তাকে চিনি না। পরবর্তীতে বলেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল অনেকদিন আগে। যখন ইবিএলে ছিলাম (২০১২ সালে) তখন ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারে জয়নাল আবেদিন সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্ত তার ক্রেডিট কার্ড হয়নি। এর পরও যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু ভুয়া কাগজপত্র তৈরিতে আমি কোনো ধরনের সহযোগিতা করিনি।

জানা গেছে, বসুন্ধরা বারিধারার জে ব্লকের ১৮ নম্বর রোডের একটি ফ্ল্যাট দেখিয়ে ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিয়েছেন রাকিব। জয়নাল আবেদিনের অন্যতম সহযোগী এই রাকিব প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়ার সময় জাল কাগজপত্র তৈরি করেন। এসব টাকা পরে জয়নাল আবেদিনের কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে রাকিবের ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। রাকিবের প্রতারণার শিকার সিটি ব্যাংক। গতকাল সিটি ব্যাংকের তৎকালীন লোন অফিসার তন্বীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তারা সব কাগজপত্র দেখেই লোন দিয়েছিলেন। প্রতারণা বুঝতে পারলে তো স্বনামধন্য ব্যাংকগুলো লোন দিত না। এখন প্রতিটি ব্যাংকের লিগ্যাল ডিপার্টমেন্ট আছে। তারা বিষয়টি দেখবেন।

জানা গেছে, রাকিবেই মতোই জয়নাল আবেদিনের সহযোগী ছাত্তার বসুন্ধরার একটি ফ্ল্যাট দেখিয়ে ৫টি অর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন করেছেন। যাদের মধ্যে ইউসিবিএল, ওয়ান ব্যাংক ও আইপিডিসির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। মাসুম ও জাহানুর নামে প্রতারক চক্রের আরও দুজন বসুন্ধরার ফ্ল্যাটের মালিক সাজিয়ে তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৬টি হোম লোন করেছেন।

এছাড়া ফজলুর রহমান নয়ন ডিবিবিএলের শেওড়াপাড়া শাখা থেকে ভুয়া ফ্ল্যাট দেখিয়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার হোম লোন নিয়েছেন। ড. সোহেল নামে এক ব্যক্তি জয়নাল আবেদিনের ফ্ল্যাট দিয়ে ২ কোটি টাকা হোম লোন করেছেন। লোনের টাকা জয়নাল আবেদিনের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। সোহেল টাকা কিংবা ফ্ল্যাট কোনোটিই পাননি।

সিআইডি জানায়, জয়নাল আবেদিন প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে ঋণ নিয়েছেন। তার নিজের একাধিক এনআইডি রয়েছে। ঋণের অবস্থা ও আর্থিক অঙ্ক গোপন করতেই তিনি একাধিক এনআইডি সংগ্রহ করেছেন।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, জয়নাল আবেদিনের প্রতারণাকাণ্ডের অন্যতম আরেক সহযোগী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি ইস্টার্ন ব্যাংক ও আইপিডিসি ব্যাংক থেকে একটি ফ্ল্যাট মর্টগেজ রেখে হোম লোন নেন। উক্ত ফ্ল্যাটটি মূলত জয়নাল আবেদীনের (ইদ্রিস) ছিল। তারা পারস্পরিক যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে এই লোনের অর্থ আত্মসাৎ করেন। জয়নাল আবেদিনের আরও এক সহযোগী মো. আল আমিন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের ডি-ব্লকের একটি ফ্ল্যাট দেখিয়ে দারুস সালাম থানার আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা হোম লোন নেন। সেই টাকার মধ্যে ৫৪ লাখ টাকা কাগুজে প্রতিষ্ঠান মেসার্স গোমতি এন্টারপ্রাইজের শহিদুল ইসলামের নামে উত্তোলন করা হয়। তার সহযোগী আবুল ফজল আইএফআইসি ব্যাংকের দারুস সালাম শাখা থেকে ৬৭ লাখ টাকার হোম লোন নেন। সেই টাকা জয়নাল আবেদিনের মালিকানাধীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান স্নেহা এন্টারপ্রাইজের ইউসিবিএল ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। মুন্সী মো. জাহানূর আলম নামে জয়নালের আরেক সহযোগী আইএফআইসি ব্যাংকের দারুস সালাম শাখা থেকে ১ কোটি টাকার হোমলোন নেন। সেই টাকা স্বরুপন প্রোপার্টিজ নামে আরও একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এছাড়া প্রতারণার মাধ্যমে ফ্ল্যাটের বিপরীতে ব্যাংক লোন নিয়েছেন জয়নাল আবেদিনের সহযোগী শহিদুল ইসলাম (সবুজ), মো. রফিকুল ইসলাম খান (আলিফ) ও রেজাউল হক (রুজেল)।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জয়নাল আবেদিনের ভুয়া এনআইডি তৈরি, মূল এনআইডির ছবি পরিবর্তনে সহায়তা করেন পেয়ার আহমেদ নামের একজন। তার আপন ছোট ভাই নির্বাচন কমিশন অফিসে চাকরি করেন। জয়নাল আবেদিনের জালিয়াতিকাণ্ডের আরেক সহযোগী লিটন মাহমুদ। তিনি জাল দলিল, এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরির কারবারে সহায়তা করেন। চতুর লিটন তার স্থাবর/অস্থাবর সব সম্পদ তার স্ত্রীর নামে করেছেন। জয়নাল আবেদিনের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সব অপকর্মে যুক্ত ছিলেন হাবিবুর রহমান মিঠু। মিঠু সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে চাকরি করেন। তার সাথে তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রারের খুবই ভালো সম্পর্ক। আজিকুল হক নামে জয়নাল আবেদিনের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ভুয়া কাগুজে প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন প্রভৃতি কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া ফ্ল্যাট মর্টগেজ রেখে ইবিএল থেকে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা লোন করেন। একই ব্যাংক থেকে একই ফ্ল্যাট মর্টগেজ রেখে ফজলুর রহমান নয়নও হোম লোন করেন। জয়নাল আবেদিনকে ব্যাংকের ভুয়া কাগজপত্র এবং ব্যাংক সংক্রান্ত সব তথ্যাদি দিয়ে সহায়তা করেন হিরু মোল্যা।

জানা গেছে, জয়নাল আবেদীনের মালিকানাধীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান স্নেহা এন্টারপ্রাইজের নামে খোলা হিসাব নম্বরে ১০ কোটি ১১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। জয়নাল নিজে হিসাবটিতে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা জমা করেছেন। আরটিজিএসের মাধ্যমে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। গোলাম সারওয়ার নামে এক ব্যক্তির হিসাব থেকে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। তার আরেকটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান ইআর ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতারণার ২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা জমা হয় এবং পরবর্তীকালে ২৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।

সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, জয়নাল আবেদিনের প্রতারণার শিকার হয়ে তারই চক্রে জড়িয়ে পড়েন ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ। তাদের একজন ব্যবসায়ী আজিজ মিতুল। মিতুল সিআইডিকে জানিয়েছেন, ঢাকার মিরপুরের দোকান বিক্রির টাকা ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটি ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারেক। তারেককে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১৭০৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ক্রয়ে রাজি করান জয়নাল। এরপর ১৩ লাখ টাকায় বায়না হয়। টাকা ও ফ্ল্যাট না পেয়ে তারেকও জয়নালের প্রতারণা ও জালিয়াতি চক্রের সদস্য হয়ে যান। পরে তিনি দলিলে তারেকের নিকট থেকে স্বাক্ষর নিয়ে লোন পেতে দলিল পৃথক তিনটি ব্যাংকে জমা দেন। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতারকচক্রে জড়িয়ে পড়েন আজিজ মিতুল।