তারকাদের ডিপফেক ভিডিওতে জুয়ার ফাঁদ
অনলাইন বিজ্ঞাপনের দুটো দৃশ্য। দুটোতেই দেশজুড়ে পরিচিত দুই সেলিব্রেটির মুখ। দৃশ্য এক ॥ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বলছেন, ‘এই অ্যাপ ২০০ শতাংশ অর্থ জেতার বিষয় নিশ্চিত করে। এখানে টাকা আয় করা সহজ। এর জন্য গেম ইনস্টল করুন এবং নিবন্ধন করুন। এখানে ৫০০, ৭৫০ ও এক হাজার টাকা দিয়ে খেলা শুরু করতে পারেন। যত বেশি খেলবেন তত বেশি আয় করবেন। আমি নিজে সবার জন্য এই গেমটি ইনস্টল করতে সুপারিশ করি।’
দৃশ্য দুই ॥ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম বলছেন, ‘আমার বন্ধু সাকিব আল হাসান একটি নতুন অ্যাপস উন্মোচন করেছে। ক্রেজিটাইম ভিত্তিক এই খেলা তোমাদের সবার পছন্দ হবে। আমি নিজেই এক সপ্তাহের বেশি সময় খেলছি। ৫০০ টাকার ব্যালেন্স দিয়ে শুরু করলে একদিনেই সে ব্যালেন্স ৫ থেকে ১০০ গুণ করতে পারবে। খেলার এক মাস পর অনেকেই গাড়ি-বাড়ি কিনে ফেলে।’
শুধু তাই নয়। বিজ্ঞাপনের এসব দৃশ্যে আরও দেখানো হচ্ছে- দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের লোগোযুক্ত সংবাদে বলা হচ্ছে, জুয়া খেলে কোটি কোটি টাকা কামানোর গল্প। আরও দেখানো হচ্ছে, এসব গেম খেলে জেতা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসছে জুয়াড়িদের বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেলের হিসাবে এবং তারা মুহূর্তেই সেসব টাকা উত্তোলন করছেন।
বলাবাহুল্য, এসবের পুরোটাই ভুয়া। অনলাইন জুয়ায় দেশের তরুণ সমাজকে প্রলুব্ধ করতে এসব বিজ্ঞাপনের ফাঁদ পাতা হয়েছে।
ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন নজরকাড়া কয়েক হাজার বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে তৈরি এসব বিজ্ঞাপন প্রচারে ঢালা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আর লোভনীয় এসব অনলাইন জুয়ার ফাঁদে ফেলে দেশি-বিদেশি জুয়ার সিন্ডিকেট প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। সে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। নীতিমালা লঙ্ঘন করে এসব জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার হলেও নির্বিকার ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের ছবি দিয়ে এআইসহ প্রযুক্তির অপব্যবহার করে এসব বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। বিভিন্ন সময় এসব বিজ্ঞাপন সরকার বন্ধ করে দিলেও আবার নতুন পেজ খুলে তারা প্রচার করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্লেষণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ আমাদের সময়কে বলেন, আমরা নিয়মিত সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া ফেসবুক পেজ ও জুয়ার ওয়েবসাইট শনাক্ত করে বিটিআরসিকে দিচ্ছি। বিটিআরসি এসব পেজ ও ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিচ্ছে। গত ছয় মাসে শতাধিক সাইট ও পেজ বন্ধ করা হয়েছে। সচেতনতা তৈরি করতে ভুয়া বিজ্ঞাপন ও অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। জুয়ার বিজ্ঞাপনে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অভিযোগ করলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
‘ভেরা২১ স্টোর’ নামে একটি ফেসবুক পেজে গত ৭ এপ্রিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লোগোসহ সংবাদ প্রচার করা হয়। সেখানে বলা হয়, বিখ্যাত ক্রিকেটার সাবিক আল হাসানের মতো এই অ্যাপটি (জুয়ার) আপনাকে মিলিনিয়র করে দেবে। এরপর প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি বিজ্ঞাপনে সাকিব আল হাসানকে ওই অ্যাপের গুণগান করতে দেখা যায়।
পেজটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে একটি ফোন নম্বর দেওয়া আছে। ফোন নম্বরটি ভিয়েতনামের। তবে পেজটিতে অধিকাংশ লাইক, কমেন্টস ও শেয়ার বাংলাদেশের বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে করা হয়েছে। বাংলাদেশের লাইসেন্সপ্রাপ্ত দাবি করা আরও একাধিক অনলাইন ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপনে সাকিব আল হাসানের ভিডিও এডিট করে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনে বিশ^সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ভুয়া মডেল হওয়ার বিষয়টি অনেকেই বিশ^াস করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রায় একইভাবে তৈরি আরেকটি ভুয়া বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায়। সেখানে বিজ্ঞাপনের মডেল বানানো হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ খ্যাত মুশফিকুর রহিমকে।
এসব ভুয়া বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে জুয়া খেলে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ আসছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রিকেটারদের ছবি ও ভিডিও দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে এসব বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনকে সত্যি বলে ধরে নিয়ে অসংখ্য মানুষ জুয়ার ফাঁদে পা দিচ্ছে। কেউ কেউ এসব বিজ্ঞাপন বিশ^াস করে কমেন্ট বক্সে ক্রিকেটারদের বকাঝকা করছেন। এর মধ্যে মনির জামান নামে একজন সাকিবের উদ্দেশে লিখেছেন, সাকিব আল হাসান একজন বাজে মানুষ। তাকে আইনের আওতায় আনা উচিত। জাহাঙ্গীর খাঁ নামে একটি আইডি থেকে কমেন্ট করা হয়েছে, একজন সংসদ সদস্যের মানুষকে এই ধরনের জুয়া খেলার অনুরোধ করা প্রতিটি সংসদ সদস্য এবং জাতির জন্য লজ্জা ও দুঃখের।
আরেকটি ডিপফেক বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, র্যাবের সদ্য সাবেক আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানের ভিডিও এডিট করে ক্যাসিনো খেলায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে খন্দকার আল মঈনের ভিডিও এডিট করে বলা হয়, আমরা এই অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) ব্লক করব না। সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রিকেটার বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করতে একটি মহান উদ্যোগ নিয়েছেন। সবাই এই অ্যাপ্লিকেশনটি চেষ্টা করতে পারেন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদের ভিডিও এডিট করে তাতে বলা হয়, এই অ্যাপ্লিকেশনটি বাংলাদেশের সব ব্যবহারকারীর জন্য নিরাপদ। এই খেলাটি সবাই আজই শুরু করতে পারেন।
ডিসমিসল্যাব নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) গত বছরের জুলাইতে নিউজ পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশনসহ জুয়ার বিজ্ঞাপন দৃশ্যমান হয়, এমন সব ওয়েবসাইট ব্লক করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে অনলাইন বেটিং বা জুয়ার প্রচারণা থেমে নেই। ডিসমিসল্যাব মাত্র একদিনেই মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে কয়েক হাজার সক্রিয় জুয়ার বিজ্ঞাপনের খোঁজ পেয়েছে। এসব বিজ্ঞাপন বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে ও হাজার হাজার ডলার ব্যয়ে প্রচার হচ্ছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে বোর্ড গেমস, স্লট, ক্যাসিনো, স্পোর্টস বেটিংয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ কামানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।
ডিসমিসল্যাবের গবেষকরা গত ৩০ মার্চ মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে নির্দিষ্ট কিছু ‘কি-ওয়ার্ড’ দিয়ে সার্চ দেন। তাতে চার হাজারের বেশি জুয়ার বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। এ ছাড়া ‘জ্যাকপট’ ও ‘অনলাইন ক্যাসিনো’ কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করেও এ লাইব্রেরিতে সার্চে জুয়ার শত শত সক্রিয় বিজ্ঞাপন দেখা যায়।
ডিসমিসল্যাব জানায়, মানুষকে প্রলুব্ধ করতে বিজ্ঞাপনে প্রায়ই তারকা খেলোয়াড় ও অভিনয়শিল্পীদের স্থির ছবি এবং ভিডিও ব্যবহার করা হচ্ছে।
মেটার অনলাইন জুয়া ও গেমিং বিজ্ঞাপন নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের একটি ফরম পূরণ করতে হবে এবং যেসব দেশ মেটার তালিকাভুক্ত, সেসব দেশকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে। তবে মেটার অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের জন্য অনুমোদিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকলেও বিজ্ঞাপনের ধরন অস্পষ্ট করে প্রচারণা চলছে। ফলে মেটার শনাক্তকরণ পদ্ধতি ধরতে পারছে না।
গবেষণায় বলা হয়, প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপনের জন্য সর্বনিম্ন এক ডলার করে নেয় ফেসবুক। এ হিসেবে বছরে বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে জুয়ার বিজ্ঞাপনে আনুমানিক ব্যয় হয় ১৫ কোটি টাকা।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্রেজি টাইম’ ও ‘গ্লোরি ক্যাসিনো’ নামের দুটি জুয়ার প্ল্যাটফর্মের বিষয়ে অধিকাংশ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। জুয়ার ভিডিও প্রচার করা পেজের অ্যাডমিনরা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক। দেশীয় এজেন্টরা বিজ্ঞাপন প্রচার, জুয়ার টাকা সংগ্রহ ও বিদেশে পাচার করে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টরা জড়িত। প্রতি বছর জুয়ার বিজ্ঞাপনে ১৫ কোটি টাকার খরচের হিসাবের কথা বলা হচ্ছে; তবে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন এর কয়েকগুণ টাকা পাচার হয়ে যায়। প্রতি বছর অনলাইন জুয়ায় পাচারের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। মোবাইল ব্যাংকগুলোর সদিচ্ছা এবং ক্যাশআউট ও ক্যাশইনের সময় এনআইডি জমা রাখার বিষয় নিশ্চিত করতে পারলেই শুধু পাচারের পরিমাণ কমানো যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইন জুয়ায় কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালকদের মতো নিম্নআয়ের মানুষও জড়িয়ে পড়ছে। জুয়ার নেশায় বুদ হয়ে অনেকেই সর্বস্ব হারাচ্ছেন। তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এই খেলা শুরুর করলেও পরে নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। জুয়ার অ্যাপসের পলিসি অনুযায়ী প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় খোয়াচ্ছেন হাজার হাজার টাকা।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি এসএম আশরাফুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দেশে যেটা অপরাধ, অন্য দেশে সেটা অপরাধ নয়। জুয়া-ক্যাসিনো অনেক দেশেই বৈধ। কিন্তু আমাদের দেশে অবৈধ হলেও এটা আমল অযোগ্য অপরাধ। তবে আমরা নিয়মিত এসব জুয়ার সাইট ও বিজ্ঞাপনের পেজ বন্ধে কাজ করছি। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের, বিশেষ যে এজেন্টদের মাধ্যমে জুয়ার অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি।