উচ্ছেদে ফাঁকা বঙ্গবাজার অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরা
বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজে দোকান কর্মচারীরা
বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দোকানপাটের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের পুঁজিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। জীবিকা টিকিয়ে রাখতে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ইট-বালু বিছিয়ে সেখানে আবারও স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন তারা। এতদিন চৌকি, বাঁশ আর ছাউনির তৈরি অস্থায়ী দোকানে ব্যবসা ধরে রাখতে পারলেও এখন আর সেই সুযোগ থাকছে না। কারণ, বঙ্গবাজারের জায়গায় নতুন বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য অস্থায়ী স্থাপনা ভাঙার কাজ শুরু করেছে ডিএসসিসি। দুই দিনের উচ্ছেদ অভিযানে ইতোমধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে গোটা বঙ্গবাজার। এতে ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবারও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ভবন তৈরিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। এ সময় তারা কোথায় ও কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবেন তা এখন অনিশ্চিত। অনেকের দাবি, এ মার্কেটের ব্যবসাই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। ব্যবসা বন্ধ থাকলে কোথায় যাবেন তা নিয়ে উদ্বেগে আছেন তারা। অপরদিকে দোকান কর্মচারীরাও চাকরি হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন। তারাও বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজ করছেন।
বঙ্গবাজারের আজিজ গার্মেন্টসের কর্ণধার মো. আব্দুল আজিজ আক্ষেপ করে বলেন, ভবন তো আর এখনই হয়ে যাচ্ছে না। এ জন্য সময় লাগবে। এ সময়ে আমরা কোথায় যাব, কিভাবে চলব তার বন্দোবস্ত না করে হুট করে দোকান ভাঙার কাজ শুরু হলো। ভবন নির্মাণকালীন আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থার আর্জি জানিয়েছি বারবার। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। এখন আমাদের রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হলো। ঈদের ব্যবসাও হয়নি। নতুন কোনো মার্কেটে দোকান নেব, তারও উপায় নেই। পরিবার নিয়ে কীভাবে বাঁচব জানি না।
দেওয়ান ফ্যাশনের কর্ণধার মো রিয়াদ হোসেনও বলেন, কোরবানির ঈদ পর্যন্ত সময় চেয়েছিলাম সবাই। নোটিশ দেওয়া হলো ঈদের পর ভাঙা হবে। কিন্তু কত তারিখে শুরু হবে তা বলা হয়নি। এই দোকানের আয়ের টাকায় পরিবার চলে। মাথার ওপর ঋণের বোঝা। ঈদে সামান্য যেটুকু আয় হয়েছে, তা দিয়ে চলেছি। এখন তো দোকানটাই নেই। অথৈ সমুদ্রে পড়ে গেলাম।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এখানকার দোকান কর্মচারী মো. রাশেদ ও মিজান। তারা জানান, দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালিকই বিপদে রয়েছেন। এমন অবস্থায় চাকরি নিয়ে তারাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তাই বিকল্প পেশার খোঁজ শুরু করছেন তারা।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, উচ্ছেদের তারিখ না জানানোয় অনেক ব্যবসায়ী মালামাল সরাতে পারেনি। দোকান মালিক উপস্থিত না থাকায় উচ্ছেদের সময় মালামাল লুট হয়েছে। গতকাল উচ্ছেদ অভিযানের দ্বিতীয় দিনেও এমন অভিযোগ তোলেন ব্যবসায়ীরা।
এমনই একজন মো. বিলাল হোসেন বলেন, ঈদের পর উচ্ছেদ হবে জানানো হলেও কবে থেকে শুরু হবে তা জানানো হয়নি। ঈদে গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে জানতে পাই, দোকান ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আজ (মঙ্গলবার) এসে দেখি, দোকানে কিছুই নেই। সব লুটপাট হয়ে গেছে। এমন অভিযোগ আরও অনেক ব্যবসায়ীর।
এর আগে গত সোমবার বঙ্গবাজারের অস্থায়ী স্থাপনা ভাঙার কাজ শুরু করে ডিএসসিসি। গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনেও অবশিষ্ট অস্থায়ী স্থাপনা অপসারণ করা হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবাজারের অস্থায়ী মার্কেটের সব জিনিসপত্র এরই মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। গোটা মার্কেট দোকানপাট ও মালামালশূন্য।
তবে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির নেতারা জানান ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, নোটিশ না দিয়ে উচ্ছেদ ও লুটপাটের অভিযোগ মিথ্যা। গতকাল দুপুরে পরিদর্শনে এসে সমিতির সদস্য শাহ আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের বারবার জানানো হয়েছে, তারা যেন আগেভাগেই তাদের মালামাল সরিয়ে নেন। যখন উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে, তখন কোথাও কোনো মালামাল ছিল না। সাংবাদিকদের দেখলে তারা এসব মিথ্যা অভিযোগ করে। আমাদের কাছে কিছুই বলে না।
সমিতির নেতাদের এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপস্থিত ব্যবসায়ীরা। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও উত্তেজনা তৈরি হয়। শেষমেশ সমিতির লোকজন স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এদিকে ব্যবসায়ীদের আরও অভিযোগ, অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় গঠিত সহায়তা তহবিলের অর্থ এখনো বণ্টন করা হয়নি। কথা হলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, আগে থেকে জানিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পরই অস্থায়ী স্থাপনা ভাঙার কাজ চলছে। চলতি মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবাজারে বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় দেবেন বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সহায়তা তহবিলে ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা রয়েছে। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১৫ কেটি টাকা সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছি, সেটা পাওয়া গেলে বণ্টন করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত বছর ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে পুরো মার্কেটের দোকানপাট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ডিএসসিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকা-ে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ) মোট দোকান ছিল দুই হাজার ৯৬১টি। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে তিন হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।