নড়বড়ে বন্ধনের জেরে বাড়ছে আত্মহনন
২০২৩ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৮৪টি। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন আত্মঘাতী হচ্ছেন ৩৯ জন। কমবয়সী কিশোর-কিশোরী, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন নানা বয়স-শ্রেণির মানুষ। এর মধ্যে উঁচু শ্রেণির প্রতিষ্ঠিত মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সম্প্রতি সংগীতশিল্পী ও সুরকার সাদী মহম্মদের আত্মহত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই গত সোমবার দিবাগত রাতে ঋণগ্রস্ত হওয়ার বার্তাযুক্ত চিরকুট লিখে মারা গেছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। এসব আত্মহননের নেপথ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধন নড়বড়ে হয়ে যাওয়াই অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে রয়েছে মোবাইল-ল্যাপটপে ডুবে থাকা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপনও।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বলছে, মানবমৃত্যুর দশটি প্রধান কারণের একটি আত্মহত্যা। দুর্ঘটনা ও হত্যাকাণ্ডজনিত মৃত্যুর পর, ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ আত্মহত্যা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা প্রতিরোধযোগ্য।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়েছে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। চাকরি, ব্যবসা কিংবা পড়ালেখার পর অবসর সময়ে মোবাইল ফোনে বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে ডুবে থাকছে মানুষ। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে না। সেই সঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য। মানুষ নিঃসঙ্গতা ও হতাশার কারণে আস্থা ও ভরসার জায়গা হারিয়ে ফেলছে। শেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, শুধু জিডিপির হিসাব করলেই একটি দেশের উন্নতি হয় না। নাগরিকদের সুখ ও স্বস্তি নিয়েও রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। পাশ্ববর্তী দেশ ভুটান অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি নাগরিকের সুখ নিয়েও কাজ করে। ফলে ভুটানে আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধও কম। রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমরা যারা সমাজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করি তাদেরও দায়িত্ব আছে। সবাই মিলেই আমরা আত্মহত্যার ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
গত ২৭ মার্চ পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি সুনন্দ রায় স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ২০২৩ সালে দেশে ১৪ হাজার ৮৪টি আত্মহত্যা সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলমান আছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। জীবন নিয়ে সংশয় বেড়েছে। বেড়েছে দারিদ্র্য, হতাশা, শূন্যতা। একাকিত্বে প্রযুক্তির অপব্যবহার তাদের চরম হতাশার মধ্যে ফেলেছে। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখন পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। কাউন্সেলিংয়ের সুবিধা বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক কর্মজীবী নারী আমাদের সময়কে জানান, তিনি ও তার স্বামী দুজনই চাকরি করেন। তার কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া দুটি ছেলেমেয়ে আছে। বাসায় এসে যতটুকু সময় পান, তখনো সন্তানরা মা-বাবার কাছ থেকে দূরে থাকে; সারাক্ষণ ডুবে থাকে মোবাইল ফোনে আর ল্যাপটপে। তিনি বলেন, ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় হয়। কিন্তু এ পরিস্থিতির উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে বুঝতে পারছি না।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আত্মঘাতী শিক্ষার্থীদের সুইসাইড নোট সূত্রে এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, সম্পর্কের টানাপড়েন, আর্থিক অনটন, পারিবারিক ও মানসিক সংকটই তাদের আত্মহননের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সমাজ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করতে হবে। যখনই বোঝা যাবে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে উঠছে, তখন তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মানসিক টানাপড়েনে ভুগলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু করাও সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন থাকেন অনেকেই। এ সময়কালে পরিবার থেকেও চাপ বেড়ে যায়। লেখাপড়ার চাপ, পরিবারের প্রত্যাশা আর প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের চাপ সামলাতে পারেন না অনেক শিক্ষার্থী। ভেঙেপড়া শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। কেউ কেউ সহপাঠী ও শিক্ষকদের নিপীড়নের ফলেও আত্মঘাতী হচ্ছেন।
‘আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম’- ফেসবুক পোস্ট দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তিকা সম্প্রতি আত্মহত্যা করেন, যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত রবিবার রাজধানীর ফুলার রোডে ঢাবির আবাসিক কোয়ার্টারে আদ্রিতা বিনতে মোশাররফ (২১) নামে এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তার বাবা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আত্মহত্যার মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে শেষ করে দিয়ে অন্যকেও শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করাটাই একটা ফৌজদারি অপরাধ। আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর এক বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এ ছাড়া প্ররোচনা বা উসকানি দেওয়া কিংবা কাউকে অপমান বা তাচ্ছিল্য করে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়াও ফৌজদারি অপরাধ। তবে আত্মহত্যা করলে দোষীর শাস্তির চেয়ে নিজের মা-বাবা, ভাইবোন ও স্বজনদের বেশি ভুক্তভোগী হতে হয়। স্বজন হারানোর বেদনার পাশাপাশি বিভিন্ন জনের কটু কথায় জীবন হয়ে অতিষ্ঠ ওঠে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বলছে, আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। আত্মহত্যার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমন ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি বন্ধ রাখতে হবে। মানসিক রোগ, মাদক ব্যবহার ইত্যাদি দ্রুত চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্য এবং কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে একটি সুরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আত্মহত্যার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে এমন ওষুধ, ধারালো জিনিস, অস্ত্র, বিষ সরিয়ে রাখতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, সাহায্য করা এবং ভালোবাসা দেখানো জরুরি। যদি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে, সে ক্ষেত্রে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি, আত্মীয়, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, বন্ধুবান্ধব বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম