বঙ্গবাজারের পোড়া ক্ষত এখনো সারেনি
অগ্নিকাণ্ডের এক বছর
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া রাজধানীর বঙ্গবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসেনি এখনো। ঈদের বাজারেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না এখানকার ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বড় উৎসব সামনে রেখে ঋণ করে বিনিয়োগ করলেও হতাশ হতে হচ্ছে তাদের। কাঠের চৌকির উপর নতুন কাপড়ের পসরা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় অলস সময় কাটছে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর।
গত বছর ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াবহ আগুনে পুরো মার্কেটের সব দোকানপাট পুড়ে ছাই হয়ে যায়; ধূলিসাৎ’ হয়ে যায় ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ীÑ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ) মোট দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বঙ্গবাজারে সব মিলিয়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি মালপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং মার্কেটগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গঠিত তহবিলে অর্থ পড়ে থাকলেও এখনো বিতরণ করা হয়নি। অপরদিকে অন্যান্য অর্থ সহায়তা কেউ পেয়েছেন, কেউ পাননি। তার ওপর ক্রেতাখরায় ব্যবসায় টানা লোকসান যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে উঠেছে।
আয়েশা এক্সপোর্ট গার্ডেনের কর্ণধার মো. আশরাফুল। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গেছে তার উপার্জনের অবলম্বন দুটি দোকান। ১৫-১৬ লাখ টাকার মালামাল হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে পুরো ব্যবসা। অগ্নিকাণ্ডের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত তিনি কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। তিনি বলেন, একদিকে ঋণের ১২ লাখ টাকা পরিশোধের দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে সাত সদস্যের পরিবারের সংসার খরচ চালিয়ে যাওয়ার চাপ। সবমিলিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। আয়-রোজগার তলানিতে ঠেকেছে। ঋণ করে বিনিয়োগ করে ব্যবসা ধরে রেখেছি। কিন্তু দিন দিন ঋণের বোঝা শুধু বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তহবিল হলো। কিন্তু এতদিনেও আমি কোনো সহায়তা পাইনি।
অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৩৫ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে ছাই হয়েছে আজিজ গার্মেন্টসের ব্যবসায়ী মো. আব্দুল আজিজের। এর আগের ঋণ থাকা সত্ত্বেও নতুন করে ঋণ করে কোনো রকমে তিনি ব্যবসা চালু রেখেছেন, ছোট পরিসরে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
আব্দুল আজিজ বলেন, আমাদের জন্য সহায়তা তহবিল গঠন করা হয়েছে। আশা করেছিলাম, সহায়তা পেলে আবার ব্যবসা দাঁড় করানো সহজ হবে। কিন্তু তা পাইনি। টাকা পাব কিনা, তাও জানি না। মার্কেট কর্তৃপক্ষ, মালিক সমিতির নেতাদের দেখাই মিলছে না। কেবল শুনছি ‘দেওয়া হবে, দেওয়া হবে’।
ঈদের বাজার ধরার আশায় নতুন করে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন দেওয়ান ফ্যাশনের কর্ণধার মো. রিয়াদ হোসেন। কিন্তু ক্রেতা খরায় হতাশ তিনি। বলেন, আগুন লাগার পর মার্কেট আবার সচল হলেও আগের সেই রূপ নেই। লাইট, ফ্যানসহ যাবতীয় সুবিধার ঘাটতি থাকায় ক্রেতাদের আগ্রহ কমে গেছে। ব্যবসা খুব খারাপ যাচ্ছে। ঈদের বাজারেও বেচাবিক্রি খুবই কম।
বিনিয়োগের অভাবে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হতে পারে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এখন ছোট্ট একটা চৌকির উপর ২০ হাজার টাকার মালামাল তুলতেও কষ্ট করতে হচ্ছে। করোনার শুরু থেকেই শুরু হয়েছে ঋণ। আগুনের পর ঋণের বোঝা আরও বেড়েছে। এখন ঋণের জালে জর্জরিত; রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুম হয় না। পুঁজির অভাবে পাশের অনেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। আমাকেও হয়তো বন্ধ করে দিতে হবে।
অল্প কিছু মালামাল নিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কষ্ট করছেন পাশের রাফি রাইয়ান ফ্যাশনের ব্যবসায়ী মো. শাহিদ হোসেনও। তিনি বলেন, আগে জমজমাট দোকান ছিল। আর এখন এই ছোট্ট চৌকির উপর ঈদের মালামাল উঠানোর সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। অগ্নিকাণ্ডের পর আমাদের জন্য অনেকে অনেক সহায়তা দিয়েছেন। কেউ কেউ পেলেও আমি কোনো টাকা পাইনি। আদৌ পাব কিনা, জানি না।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ঈদে বঙ্গবাজারের আগেকার সেই জৌলুস আর নেই; অনেকটাই মলিন। আগে ঈদ মৌসুমে পাইকারিসহ খুচরা বিক্রি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেত। এবার উল্টো স্থবির হয়ে পড়েছে, আক্ষেপের সঙ্গে বলছেন ব্যবসায়ীরা।
গত বছর অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় গঠন করা হয় সহায়তা তহবিল। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াতে এ তহবিলে আর্থিক সহায়তা করেন। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, এ তহবিলে এ পর্যন্ত মোট ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে, যা এখনো অলস পড়ে আছে। বিতরণ হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বঙ্গবাজারের অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল সেখানে জমা হওয়া ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা এখনো বিতরণ করা হয়নি। কারণ, ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় এ অর্থ খুবই কম। আমরা জানতে পেরেছি প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৫ কোটি টাকার অর্থ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। এটা পাওয়া গেলে ব্যবসায়ীদের ভালো অঙ্কের সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হবে। ঈদের পর এটা বিতরণ করা হবে বলে আশা করছি।
একই কথা জানিয়েছেন এ মার্কেটের চারটি ইউনিটের ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা। ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের বিষয়ে আদর্শ মার্কেট ইউনিটের কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সিটি করপোরেশন তাদের সঙ্গে নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই মেনে নেবেন তারা। তারা চান দ্রুত আবার ব্যবসায় ফিরতে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
পুড়ে যাওয়া মার্কেটের জমিতে বহুতল ভবন করা হবে। কিন্তু সেটি নির্মাণে দীর্ঘসময় প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এ সময়টাতে তারা কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবেন কিংবা কোথায় যাবেনÑ সে দিকটিও বিবেচনায় আনার তাগিদ দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।