দাম কমল ডিজেল ও কেরোসিনের
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিলিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২ টাকা ২৫ পয়সা কমিয়ে ১০৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অকটেন ১২৬ টাকা ও পেট্রলের দাম ১২২ টাকা অপরিবর্তিতই রয়েছে। রবিবার রাত ১২টা থেকেই নতুন দর কার্যকর হবে বলে গতকাল জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়। এদিকে দু-দফা জ্বালানি তেলের দাম কমলেও এর সঙ্গে সমন্বয় করে গণপরিবহনের ভাড়া কমাতে কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ভোক্তারা দাম কমানোর সুফল পাবেন না জানিয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ডিজেলের সামান্য দাম কমায় পরিবহন ভাড়া কমবে না, মূলত পরিবহন ব্যবসায়ীরাই এতে লাভবান হবেন।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে সরকার গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ঘোষণা করে। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশে কমবে, বিশ^বাজারে বাড়লে দেশেও বাড়বে। বিষয়টি এলপিজির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির মতোই হবে। এ পদ্ধতিতে প্রথম জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয় গত ৭ মার্চ। তখন ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারপ্রতি ৭৫ পয়সা, অকটেনে ৪ টাকা এবং পেট্রলে ৩ টাকা কমানো হয়।
দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। এটি সাধারণত কৃষি সেচে, জেনারেটর এবং পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য সময় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও এবার এক মাসের মধ্যে দু-দফায় ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩ টাকা কমানো হলেও ভাড়া কমানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে ভাড়া কমানোর দাবি জানিয়ে গতকাল এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, ইতোমধ্যে দু-দফা জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলেও বাস ও পণ্যবাহী পরিবহনের ভাড়া কমানোর কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি। জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া কমানোর দাবি জানান তিনি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ডিজেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একজন পরিচালক বলেন, যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করে। বিআরটিএ শুধু সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। এখন পর্যন্ত সরকারের এ ধরনের কোনো নির্দেশনা পাইনি।
এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ভাড়া নির্ধারণসংক্রান্ত একটা কমিটি আছে আমাদের। বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে বলেছি- কমিটির বৈঠক ঢেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে।
আন্তর্জাতিক বাজার অনুসারে তেলের দাম আরও কমা উচিত ছিল জানিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে পেট্রল ও অকটেনের মূল্য সমন্বয় ঠিক আছে। কিন্তু ডিজেলের ক্ষেত্রে যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনের ভাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওঠানামার ফর্মুলা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ডিজেলের দাম সমন্বয় করা যেতে পারে, না হয় সমন্বয় করে লাভ নেই। কারণ ডিজেলের সঙ্গে সমন্বয় ভাড়া না কমলে বাড়তি টাকাটা তো ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাবে। সাধারণ মানুষ এর সুবিধা পাবে না।
বিপিসির লোকসান হচ্ছে- এমন যুক্তিতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রলে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনে লিটারপ্রতি ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ৩০ আগস্ট এ চার ধরনের জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা করে অর্থাৎ ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে মাত্র ৩-৪ শতাংশ কমানো হয়েছিল।
বিপিসির মুনাফা : বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিট মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা এবং শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে সরকার নিয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি। ২০২১-২২ অর্থবছরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামপ্রতি ব্যারেল ১৪০ ডলার আর ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে গেলেও বর্তমানে দাম কমে ৯৫ ডলারের মতো হয়েছে।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় এক কোটি টন। এর মধ্যে বিপিসি ৬৫-৭০ লাখ টন ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ২০-২৫ লাখ টন আমদানি করে। আর দেশের পরিশোধনাগার থেকে কিছু তেল পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিমাসে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। অনেকটা এ প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দামও নির্ধারণ করবে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। যদিও এই মূল্য নির্ধারণের একক এখতিয়ার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হওয়া উচিত বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি। আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।