পাপুলের শ্যালিকা জেসমিনের আয়কর রিটার্ন জালিয়াতি

তাবারুল হক
৩১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
পাপুলের শ্যালিকা জেসমিনের আয়কর রিটার্ন জালিয়াতি

অর্থ ও মানবপাচারের দায়ে কুয়েতে দণ্ডিত লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের আয়কর রিটার্ন দাখিলে জালিয়াতি ও প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের অনুসন্ধান বলছে, জেসমিন তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে পৃথক কর সার্কেলে দুটি টিআইএন খোলেন। দুলাভাই পাপুলের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকার মালিক হয়ে ২০২১ সালে তিনি তার রিটার্ন দাখিলে জালিয়াতির আশ্রয় নেন। ওই বছর প্রস্তুত করা হয় জেসমিনের পাঁচ করবর্ষের রিটার্ন। এ ছাড়া অডিট প্রতিবেদন ও ব্যাংক বিবরণী প্রস্তুতেও ঘষামাজার মাধ্যমে জালিয়াতি করেছেন তিনি। এ ঘটনায় জেসমিন প্রধানসহ আয়কর অফিসের দুজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছেন দুদকের সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি অনুসন্ধানাধীন বিষয়, সে জন্য এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। যদি কমিশন থেকে মামলার অনুমোদন দেওয়া হয় তখন জানানো যাবে।’

এ বিষয়ে জেসমিন প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর ২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে সহিদ ইসলাম পাপুল, তার স্ত্রী, কন্যা ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

জেসমিন প্রধান ঢাকা কর অঞ্চল-৮ অফিসের সার্কেল ১৬৫-এর কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে যোগসাজশের মাধ্যমে ২০১৬-১৭ করবর্ষ থেকে ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন একই দিনে দাখিল করেন। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কর সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অংক পরিবর্তন ও পরিমার্জন করেন।

এ সংক্রান্ত দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, জেসমিন প্রধানের ওই পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্নের রেকর্ড থেকে দেখা যায়- তার মোট আয়ের কলামে ঘষামাজা রয়েছে। ৭৪ ধারার কলামে, ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ কলামে ঘষামাজা, হাতে নগদ ও ব্যাংক স্থিতি কলামে, রিটার্ন রেজিস্টারের নিট সম্পদ কলামে ভিন্ন হাতের লেখায় বিভিন্ন সংখ্যা বসানো ছাড়াও রিটার্ন রেজিস্টারে পারিবারিক ব্যয়ে আয়কর রিটার্নে ভিন্নতা পাওয়া যায়।

জেসমিন প্রধান ওই পাঁচ করবর্ষ পর্যন্ত সর্বজনীন স্ব-নির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর রিটার্নের সঙ্গে যেসব ব্যাংক বিবরণী জমা দিয়েছেন, তার প্রতিটির জেনারেটেড ও প্রিন্টেড তারিখ ২০২০ সাল। এ ছাড়া তার আয়কর রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা অডিট প্রতিবেদনও জাল করেছেন। পাঁচ বছরের অডিট প্রতিবেদনগুলো পৃথক থাকার কথা থাকলেও, সেগুলো ২০২০ সালে প্রস্তুত করা বলে অনুসন্ধানে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

জেসমিন প্রধানের স্টক রেজিস্টার ও মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টার পর্যালোচনা করার কথা উল্লেখ করে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই করদাতার ২০১৬-১৭ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় ৩,৫০,০০০ টাকা; ২০১৭-১৮ করবর্ষে ৩,৫০,০০০ টাকা, ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৪,৫০,০০০ টাকা; ২০১৯-২০ করবর্ষে ৪,৫০,০০০ টাকা মোট আয় লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। কিন্তু আয়কর রিটার্নে ২০১৬-১৭ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় মোট আয় ১৩,৫০,০০০ টাকা, ২০১৭-১৮ করবর্ষে ২১,৫০,০০০ টাকা; ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৩৬,৪৫,০০০ টাকা এবং ২০১৯-২০ করবর্ষে মোট আয় রয়েছে ৪৩,৭৫,০০০ টাকা। এই করদাতার আয়কর রিটার্নের সঙ্গে স্টক রেজিস্টার এবং মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টারের কোনো মিল পাওয়া যায়নি; অর্থাৎ মূল রিটার্নগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে।

জেসমিন প্রধান ঢাকা কর অঞ্চল ৮-এর সার্কেল ১৬৫-এর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে রিটার্ন রেজিস্টার ঘষামাজা করে মোট আয়, মোট সম্পদ, নিট সম্পদ, পারিবারিক ব্যয় ইত্যাদি পরিবর্তন করান। এ ঘটনায় ঢাকার একটি কর অঞ্চলের এক উপকর কমিশনার ও উচ্চমান সহকারী এবং করদাতা জেসমিন প্রধান পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আয়কর রিটার্ন পরিবর্তনসহ রেজিস্টার ঘষামাজা করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয় দুদকের প্রতিবেদনে।

সম্প্রতি কমিশনে প্রতিবেদনটি দাখিল করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মশিউর রহমান। প্রতিবেদনে অভিযোগ-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কাজী সহিদ ইসলাম পাপুল। পরে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করিয়ে আনেন। অর্থ ও মানবপাচার এবং ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালের জুনে কুয়েতে গ্রেপ্তার হন পাপুল। ওই মামলার বিচার শেষে ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি তাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেয় কুয়েতের একটি আদালত। পরে সাজা বাড়িয়ে ৭ বছর করা হয়। কুয়েতের রায়ের নথি হাতে পাওয়ার পর ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাপুলের সংসদ সদস্যপদ বাতিল করে জাতীয় সংসদ।