যোগদানের সময় পুষ্পডালা বিদায়বেলা কলঙ্কমালা

বিএসএমএমইউ ।। সব ভিসিই শেষ সময়ে পালিয়েছেন আমি এখনো অফিস করছি

আজাদুল আদনান
২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
যোগদানের সময় পুষ্পডালা বিদায়বেলা কলঙ্কমালা


তিন বছর আগে ২০২১ সালের ২৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যের পদে বসেন অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। সে সময় শুভেচ্ছা জানাতে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিড় দেখা গেলেও উল্টোচিত্র বিদায়বেলায়। চিকিৎসক থেকে শুরু করে কাউকে পাশে পেলেন না। যারা এতদিন তোষামোদি করতেন, তারাই সমালোচনায় মুখর বিদায়ী উপাচার্যের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দায়িত্ব পালনকালে উপাচার্য শারফুদ্দিন গবেষণা বৃদ্ধি, বেশ কিছু নতুন বিভাগ এবং দেশের একমাত্র সর্বাধুনিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপন করেছেন। কিন্তু অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা কর্মকা-ে বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। শেষ সময়ে এসেও নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। তবে এমন বিদায়ের ঘটনা বিশ^বিদ্যালয়টিতে নতুন নয়।

অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ছিল বেশি : শারফুদ্দিন আহমেদের আগে এই পদে ছিলেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া। শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে শতাধিক চিকিৎসক এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের

পদোন্নতি, নিয়মিতকরণ এবং নিয়োগের অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। এবার একই পথে হাঁটলেন অধ্যাপক শারফুদ্দিনও। দায়িত্ব পালনের তিন বছরে নিয়োগ ও কেনাকাটায় অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতাসহ অভিযোগের পাহাড় ছিল তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে নিয়োগ ও পদোন্নতির নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। এমডি-এমএস কোর্সে শর্তপূরণ না করেই ভর্তি, দুই বছর ভর্তির বিজ্ঞপ্তি থেকে নিয়ম উধাও এবং ছেলে-ছেলের বউকে সুবিধা দিতে গিয়ে নিয়ম ভঙ্গের ঘটনা ঘটে।

অ্যাডহকে নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তিদের শেষ মেয়াদে স্থায়ীকরণ নিয়ে গত তিন সপ্তাহ ধরে বিশ^বিদ্যালয়টির চিকিৎসকদের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদের মেয়াদ শেষের মুহূর্তে এসে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে তার ব্যক্তিগত সহকারী ডা. রাসেল আহমেদ ও শিপনসহ কয়েকজনকে মারধর করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

বিশ^বিদ্যালয়টির শীর্ষ পর্যায়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘অতীতে উপাচার্যের পদে যারা বসেছেন অধিকাংশের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তবে সবগুলোকে ছাড়িয়ে গেছেন শারফুদ্দিন আহমেদ। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপি দেখেননি, দেখেছেন টাকা। প্রতিটি নিয়োগে ৩০ থেকে ৪০ লাখ নিয়েছেন। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেক আশা নিয়ে তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেটি তিনি ধরে রাখতে পারেননি। ফলে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ফুলের শুভেচ্ছা পেলেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায়টাও নিতে পারছেন না।

শেষ দিনেও নিয়োগ-তদবিরের ভিড় : গতকাল সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ঘুরে দেখা গেছে, সবসময় চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীতে ভরপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন সুনসান নীরবতা। অধিকাংশ কক্ষেই চেয়ারগুলোতে পাওয়া যায়নি কর্মকর্তাদের। এ দিন সকালে কার্যালয়ে এলেও প্রোগ্রামের কথা বলে বেরিয়ে যান শারফুদ্দিন আহমেদ। পরে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আসেন। এ সময় কক্ষের ভেতরে-বাইরে ভিড় দেখা যায়। কেউ এসেছেন নিয়োগের বৈধতা নিতে, কেউবা নিয়োগ পেতে। এ ছাড়া অনেককে তদবির করতেও দেখা যায়।

থমথমে পরিস্থিতি, অবস্থান নেন স্বাচিপের নেতাকর্মীরা : শেষ বেলায় নতুন করে যাতে কোনো নিয়োগ কিংবা তৎপরতা উপাচার্য দেখাতে না পারেন সে জন্য গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অবস্থান নেন বিএসএমএমইউর স্বাচিপ নেতাকর্মীরা। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক থাকতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও। সবমিলিয়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে প্রশাসনিক ভবনে।

বিএসএমএমইউর স্বাচিপের সদস্য সচিব অধ্যাপক মো. আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার টিটো আমাদের সময়কে বলেন, ‘উপাচার্য যদি শেষ সময়ে রুটিন কাজগুলোই করেন, তাহলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি সিন্ডিকেট মিটিং বা নিয়োগের অপতৎপরতা চালান, তাহলে আমাদের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।’

অন্যরা পালিয়েছেন, আমি শেষ সময়েও অফিস করেছি : তবে নিয়োগে অনিয়মসহ সব ধরনের অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছেন উপাচার্য শারফুদ্দিন। দায়িত্বের শেষ দিনে গতকাল একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাদের সময়কে বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি কাদরী (অধ্যাপক ডা. কাদরী) স্যারকে চেয়ার ভেঙে বের করে দিয়েছিল মেডিক্যাল অফিসাররা। তাদের অনেকেই এখনো বিএসএমএমইউতে আছে। এই জায়গাটা থেকে কেউই শান্তিতে এখন পর্যন্ত বের হয়ে যেতে পারেননি। যে কোনো ভিসির শেষ সময়ে এখানে এ রকম ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ব্লক দিয়ে পালিয়েছিলেন। এর আগে অধ্যাপক কামরুল হাসান খান প্যাথলজি থেকে সোজা বের হয়ে গিয়েছিলেন। আমি কিন্তু শেষ দিনে এসেও অফিস করছি, যা অন্যরা পারেননি। সুতরাং আমি কোনো কিছুতেই ভীত নই।’

নিজের কাজের ব্যাপারে এই উপাচার্য বলেন, ‘গবেষণায় বিএসএমএমইউর বাজেট ছিল ৪ কোটি টাকা, সেটিকে ৩২ কোটিতে উন্নীত করেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ক্যাডাভেরিক লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও জোড়া শিশু আলাদা করা হয়। এখানে এসে শুরুতেই জার্নাল ইনডেক্স করেছি, ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকের সংখ্যা যেন আরও বাড়ে সে ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু আমি রোবটিক ট্রিটমেন্ট ও বায়োব্যাংকটাও চেষ্টা করেছি, আনতে পারিনি।’

সমালোচনা প্রসঙ্গে শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমি বিশ্বাস করি, ৬ মাস পর আপনারাই মূল্যায়ন করবেন আমি কেমন ছিলাম।’ তিনি বলেন, শেষ বেলায় তার তেমন কোনো আক্ষেপ নেই। তবে কিছু মানুষ এত তাড়াতাড়ি চোখ উল্টাতে পারে তা তার জানা ছিল না। টাকার বিনিময়ে নিয়োগের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাকির সুমন নামে একজন একই অভিযোগ করেছে। সে নিজেও আমার হাতে নিয়োগ পেয়েছে। তাকেই বরং জিজ্ঞেস করবেন সে কত টাকা দিয়েছে।’

আজ পদে বসছেন নতুন উপাচার্য : নতুন উপাচার্য হিসেবে আজ দায়িত্ব নিচ্ছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক। বৃহস্পতিবারটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই মহাপরিচালককে চার বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার।