রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ভাটা
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের আগুন নিভে গেলেও তার আঁচ এখনো অনুভব করছে রাজধানীর রেস্তোরাঁ বাণিজ্য। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় রাজধানীর জমকালো রেস্তোরাঁগুলোতে গ্রাহক উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এদিকে, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানীর ধানমন্ডি, খিলগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় রাজউক, সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও র্যাব। এতে বন্ধ হয়ে যায় অসংখ্য নামিদামি প্রতিষ্ঠান। একদিকে ক্রেতা খরা, অপরদিকে অভিযান আতঙ্ক- এ দুই কারণে গোটা রেস্তোরাঁ বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। রোজার মাসে ব্যবসার বদলে বড় লোকসানের মুখে আছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর রেস্তোরাঁ খাতে স্থবিরতা নেমেছে। খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, রেস্তোরাঁগুলোতে আগের মতো গ্রাহক সমাগম নেই। বিগত বছরগুলোর রোজার মৌসুমের মতো ইফতার, রাতের খাবার ও সেহরি ঘিরে ব্যস্ত পরিবেশ আর নেই। ব্যবসা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। লোকসানের পরিমাণ কমাতে এ খাতে বিনিয়োগও কমেছে। খাবারের আইটেম কমাতে বাধ্য হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ছাঁটাই আতঙ্কে আছেন রেস্তোরাঁর কর্মীরা। ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় বেতন-বোনাস নিয়েও অনিশ্চয়তা বেড়েছে তাদের।
রাজধানীর অন্যতম অভিজাত ইফতার বাজার বেইলি রোডে এ বছর আগের মতো জাঁকজমক নেই। এখানকার নবাবী ভোজ, সুলতান’স ডাইনসহ আরও বেশ কতগুলো প্রতিষ্ঠানে এখনো তালা ঝুলছে। যেগুলো খোলা আছে, সেগুলোতেও ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আল মদিনা প্যালেসের নিচতলায় খোলা রয়েছে কেক টাউন ও বেইলি বার বি কিউ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান।
বেইলি বার বি কিউয়ের ম্যানেজার সুরঞ্জিৎ জয়ধর বলেন, ক্রেতারা আতঙ্কে আসছেন না। মন্দা সময় পার করায় বিনিয়োগ কমেছে। আইটেম কমাতে বাধ্য হয়েছি। কেক টাউনের ম্যানেজার মো. সায়ান্তো বলেন, রোজায় যেখানে বাড়তি ইফতারের বাণিজ্য থাকে, সেখানে এবার পরিবেশ বদলে গেছে। এই আল মদিনা প্যালেসের রোস্টার ক্যাফে ও পিজ্জা মাস্তানের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ। এখানকার সুইস ক্যাফের ম্যানেজার সিরাজুল ইসলামও জানান, বেচা-বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। খুব খারাপ সময় পার করতে হচ্ছে।
ব্যবসার জন্য ১২টি সনদ থাকার পরও অগ্নিকাণ্ড ইস্যুতে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন নবাবী ভোজের নির্বাহী পরিচালক বিপু চৌধুরী। তিনি বলেন, কী করলে ব্যবসা দ্রুত চালু হবে, সেটাও বলা হচ্ছে না। শুধু দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও কর্মচারীদের বেতনসহ অনেক খরচ রয়েছে। দৈনিক বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে চললে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
একই অবস্থা রাজধানীর অন্য এলাকাগুলোতেও। ধানমন্ডি ৯-এ এলাকার হোয়াইট হল, প্যান প্যাসিফিক লাউঞ্জ, এরিস্টোক্রেট লাউঞ্জ, গ্যালিটোস, চাপ ঘরসহ ১৩টি রেস্তোরাঁ বন্ধ রয়েছে। আশপাশের যেগুলো খোলা রয়েছে, সেগুলোর ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্যান প্যাসিফিক লাউঞ্জ ও এরিস্টোক্রেট লাউঞ্জের কর্ণধার আবুল এহসান আনোয়ার বলেন, আমরা তো সব করতে রাজি, কিন্তু আমাদের কিছুই বলা হচ্ছে না। এ অফিস, সে অফিস ঘুরছি। এটা হয়রানি ছাড়া আর কি! সামনে ঈদ, আমার দুই প্রতিষ্ঠানের ২২০ জন কর্মচারীর জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।
রাজধানীর উত্তরার রেস্তোরাঁগুলোতেও গ্রাহক কমে গেছে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ব্রোকলি রেস্তোরাঁর কর্ণধার নরুল আফসার বলেন, একদিকে গ্রাহক কমে যাওয়ায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবসা কমে গেছে। এর মধ্যে দফায় দফায় হয়রানি। আমাদের একটি সংস্থা নির্দেশনা দিলে হয়। তা না করে, একেক সংস্থা এসে একেকভাবে হেনস্থা করছে।
খিলগাঁও এলাকার রেস্তোরাঁ ও আধুনিক ফুড কোর্টগুলোতেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবসা কমেছে। গত রোজার চেয়ে এবার বিনিয়োগও কমাতে বাধ্য হয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন রেস্তোরাঁ কর্মচারী জানান, ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় ঈদের বেতন-বোনাস নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা। বিশেষ করে বন্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। রয়েছে চাকরি হারানোর শঙ্কাও।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাবে রাজধানীতে প্রায় ২৭ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সদস্য। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর ২০০টির বেশি রেস্তোঁরা বন্ধ রয়েছে।
দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢালাওভাবে রেস্তোরাঁ বন্ধ ও ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হচ্ছে- এমন দাবি করছেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান। তিনি বলেন, পুরো ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, একের পর এক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছেÑ তাতে সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। অপরদিকে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণায় গ্রাহকদের মনেও আতঙ্ক বেড়েছে, রেস্তোরাঁগুলোতে গ্রাহক কমে গেছে। এতে বাণিজ্য হারাতে হচ্ছে। গোটা খাত ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ করে দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে ইমরান বলেন, খাতটি রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। নানা ধরনের লাইসেন্স/অনুমতি নিয়ে এবং সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে এই সেক্টর গড়ে উঠেছে। এখন অনেকে ভয়ে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছেন। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি অব্যবস্থাপনার দায় কেন রেস্তোরাঁ মালিকরা নেবেন?
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম