বিশ্বব্যাপী আইএসের ভয়ঙ্কর কিছু হামলা

আজহারুল ইসলাম অভি
২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিশ্বব্যাপী আইএসের ভয়ঙ্কর কিছু হামলা

আইএস কিংবা আইএসআইএস-কে। নানান নামে পরিচিত এক সন্ত্রাসী সংগঠন। অসংখ্য হামলার জন্য দায়ী এই সংগঠনটি। প্রধানত আফগানিস্তান ও আশপাশের অঞ্চলে তারা এসব হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মসজিদে বোমা হামলা, কাবুলে রাশিয়ার দূতাবাসে হামলা, ২০২১ সালে কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলার মতো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা রয়েছে। এসব হামলায় অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকান সেনারাও রয়েছে। সম্প্রতি তারা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর একটি কনসার্ট হলে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে প্রায় ১৩৩ জন মারা গেছে। আইএসআইএস-কের সন্ত্রাসের ইতিহাস ঘাঁটলে এটা পরিষ্কার যে সতর্ক হয়ে ওঠার লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ওপর অব্যাহত হুমকি তৈরির সক্ষমতাও তাদের রয়েছে। আমাদের আজকের আয়োজন আইএসআইএসের বর্বরোচিত কিছু হামলা নিয়ে। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজহারুল ইসলাম অভি

ফ্রান্সে হামলা

১৩ নভেম্বর ২০১৫

১৩ নভেম্বর ২০১৫ তারিখের সন্ধ্যায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ও রাজধানীর ঠিক উত্তরে সাঁ-দ্যনি শহরে ধারাবাহিক ও সমন্বিত সন্ত্রাসী আক্রমণ চালায় আইএস। এ সময় গণহত্যা, আত্মঘাতী বোমা হামলা, বোমা হামলা ও জিম্মি করার মতো ন্যক্কারজনক কাজ করে ইসলামিক স্টেট। কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় সময় ২১:১৬টার সময়ে, সাঁ-দ্যনির শহরের উত্তর শহরতলিতে স্তাদ দ্য ফ্রঁস ক্রীড়াক্ষেত্রের বাইরে তিনটি পৃথক আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং কেন্দ্রীয় প্যারিসের কাছাকাছি চারটি ভিন্ন স্থানে গণহত্যা ও আত্মঘাতী বোমা হামলা ঘটে। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি হয় বাতাক্লঁ নাট্যশালাতে যেখানে আক্রমণকারীরা সেখানে থাকা নাগরিকদের জিম্মি করে; পরে পুলিশ ভারী অস্ত্রসহ সেখানে অভিযান চালায় যা শেষ হয় ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫৮ কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় সময়ে। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট (আইএসআইএল) এই হামলার দায় স্বীকার করে। এই হামলায় অন্তত ১২৮ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৮৯ জন নিহত হন বাতাক্লঁ নাট্যশালাতে। এই হামলায় প্রায় ৪১৫ জন আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যার মধ্যে ৮০ জনের অবস্থাকে গুরুতর হিসেবে অভিহিত করা হয়। আক্রমণে নিহতরা ছাড়াও ৭ জন আক্রমণকারী মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফ্রান্সে ঘটা সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা ছিল এটি।

বাগদাদে বোমা হামলা

৩ জুলাই ২০১৬

বাগদাদে ২০১৬ সালের ২ জুলাই শনিবার রাতে বোমা হামলা চালিয়েছিল তথাকথিত আইএস। ইরাকের পুলিশ জানিয়েছিল, বাগদাদে সেই বিস্ফোরণে অন্তত ৭৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৩১ জন। তথাকথিত ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এই হামলাটি চালিয়েছে বলে দাবি করছে। ২ জুলাই শনিবার রাতে রাজধানীর কারাডায় বাণিজ্যিক এলাকায় একটি রেস্তোরাঁর সামনে একটি গাড়ি বোমার মাধ্যমে এই হামলা চালানো হয়। জানা যায় রমজান উপলক্ষে ইফতার-পরবর্তী ওই সময়টিতে রাস্তায় প্রচুর মানুষ চলাচল করছিল। পরের দিকে রাজধানীর উত্তরাঞ্চলে দ্বিতীয় আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় ওই হামলাটিতে আরও ৫ জন নিহত হয়। হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আইএসের হাত থেকে ফাল্লুজা পুনর্দখল করে নেওয়া ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনী। সেই হামলায় যে গাড়িটি ব্যবহার করা হয় সেটি ছিল মূলত একটি রেফ্রিজারেটর ভ্যান এবং খবরে বলা হচ্ছে ভ্যানটির ফ্রিজার অংশ বিস্ফোরক দিয়ে পূর্ণ ছিল। বাগদাদের সেই হামলায় নিহতদের একটি বড় অংশই শিশু। বিস্ফোরণের পর প্রধান সড়কে বিরাট অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এতে বেশ কয়েকটি ভবনের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

জর্ডানে হামলা

১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

জর্ডানের দক্ষিণের শহর কারাকে বন্দুকধারীদের গুলিতে কানাডার পর্যটকসহ ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আইএস-এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আইএস’র চার যোদ্ধা রবিবার জর্ডানে ওই হামলা চালিয়েছে এবং তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অভিযান শেষ হয়েছে।’ রাজধানী আম্মান থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণের শহর কারাকে রবিবার একদল বন্দুকধারী প্রথমে টহল পুলিশের ওপর হামলা করে। পরে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হলে হামলাকারীরা একটি গাড়িতে করে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত দেশটির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি দুর্গে ঢুকে পড়ে। সেখানে পুলিশ পোস্টে হামলার পর তারা দুর্গের ভেতরে অবস্থান নেয়। এতে দুর্গের ভেতরে কয়েকজন পর্যটক আটকা পড়েন, তৈরি হয় জিম্মি সংকট। ওইদিন রাতে জর্ডান পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রবিবার তারা চারজন ‘সন্ত্রাসী’কে হত্যা করেছে। ‘সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলির পর তাদের দুর্গের বাইরে বের করে এনে হত্যা করা হয়।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় ১০ জন পর্যটককে অক্ষত অবস্থায় দুর্গ থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানায় পুলিশ। অন্তত ৩০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শ্রীলংকায় হামলা

২১ এপ্রিল ২০১৯

শ্রীলংকায় ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল স্টার সানডের সকালে চার্চ ও হোটেলে আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় ইসলামিক স্টেট গ্রুপ (আইএস)। শ্রীলংকায় সেই আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় ৩২১ জন নিহত হয়। দেশটির সরকার যখন স্থানীয় মুসলিম মৌলবাদী একটি সংগঠনকে দায়ী করছিল ঠিক তখনই এর দায় স্বীকার করে আইএস। খবর এএফপির। আইএসের প্রচারণা সংস্থা আমাক এক বিবৃতিতে জানায়, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সদস্য এবং শ্রীলংকার খ্রিস্টানদের লক্ষ্য করে রবিবার ইসলামিক স্টেট গ্রুপ যোদ্ধারা হামলা চালিয়েছে। ক্রাইস্টচার্চে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি এই হামলা চালায় বলে জানা যায়। পুলিশের একটি সূত্র এএফপিকে জানায়, কলম্বোর একজন ধনাঢ্য মুসলিম ব্যবসায়ীর দুই ছেলে এ হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২১ এপ্রিল রবিবার ইস্টার সানডেতে শ্রীলংকার তিনটি গির্জা, তিনটি হোটেলসহ অন্তত আটটি স্থানে পরপর বোমা হামলা হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৬ জন বিদেশি নাগরিক। আহত পাঁচ শতাধিক। ওইদিন ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় উৎসব ইস্টার সানডে। হামলার সময় তিন গির্জায় ইস্টার সানডের প্রার্থনা চলছিল।

কাবুল বিমানবন্দরে হামলা

২৬ আগস্ট ২০২১

২০২১ সালের ২৬ আগস্ট আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরে ভয়াবহ বোমা হামলা চালায় সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসআইএস। ওই বোমা বিস্ফোরণে ১৩ মার্কিন সেনা ছাড়াও ১৭০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সেনাদের প্রত্যাহার করা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। আর এই সুযোগে তালেবানের যোদ্ধারা রাজধানী কাবুল দখল করে নেন। তালেবান শাসনের ভয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে হাজার হাজার মানুষ কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরে জড়ো হন। তখনই চালানো হয় এমন ন্যক্কারজনক হামলা। ভয়াবহ এই হামলার আগে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নাগরিকদের বিমানবন্দর থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিল। কারণ মার্কিন গোয়েন্দারা জানতে পেরেছিলেন আইএসআইএস-এর তালেবান শাখা আইএস-কে বিমানবন্দরে হামলা চালাবে। এমন হুশিয়ারির কয়েক ঘণ্টা পর এক আত্মঘাতী জঙ্গি যাত্রীবেশে নিজ শরীরে বোমা বেঁধে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়।


মস্কোতে হামলা

২২ মার্চ ২০২৪

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর একটি কনসার্ট হলে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। শুক্রবার (২২ মার্চ) রাতে ক্রকাস সিটি হলে এ ঘটনা ঘটে। রুশ তদন্তকারীরা বলেছেন, নিহতের সংখ্যা ১৩৩ জনের বেশি। এদিকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, হামলায় প্রায় ১৪৫ জন আহত হয়েছেন; তাদের মধ্যে ৬০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রক সংগীতের দল ‘পিকনিক’ মস্কোর শহরতলির ৬২০০ আসনের ক্রোকাস সিটি হলে অনুষ্ঠান শুরু করার ঠিক আগে বন্দুকধারীরা বেসামরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। হলটি তখন কানায় কানায় ভরা ছিল। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সামরিক বাহিনীর মতো পোশাক পরা বন্দুকধারীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে সংগীতানুষ্ঠানে আগত লোকজনের দিকে নির্বিচার গুলি ছোড়ে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, হঠাৎ তারা পেছন থেকে গুলির শব্দ শুনতে পান। শোনা যায় বিস্ফোরণের শব্দও। এ সময় সবাই দৌড়ে এসকেলেটরের দিকে চলে যায়।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে বেসলান স্কুলে হামলার ঘটনার পর থেকে এটিই রাশিয়ায় হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা। যে কারণে রাশিয়ায় হামলা : রাশিয়াকে কেন লক্ষ্যবস্তু বানাল আইএসআইএস-কে রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের প্রতি শত্রুতার ইতিহাস বিবেচনায় নিলে মস্কোর কনসার্ট হলে আইএসআইএস-কের হামলাটি মাত্রার দিক থেকে তীব্রতম। আইএসআইএস-কের হামলার একটা কারণ হতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে, নির্দিষ্ট করে সিরিয়ায়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সামরিক আগ্রাসন। পুতিন সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন। পরিষ্কারভাবে সেখানে আইএসআইএস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাশিয়ান সেনারা লড়াই করছে। আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি সেখানে রাশিয়ার প্রভাব বজায় রাখার উদ্দেশ্য থেকেই পুতিন সেখানে সেনা পাঠিয়েছেন। এটা সরাসরি আইএসআইএসের উদ্দেশ্যবিরোধী। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইএসআইএস-কে রাশিয়া মুসলিম নিপীড়ক দেশ বলে মনে করে। এ কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বিরোধ। এ ছাড়া আইএসআইএস-কের অনেক সদস্য এসেছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো থেকে। তারা তাদের দুর্দশার ঐতিহাসিক কারণ মনে করে রাশিয়াকে। রাশিয়ার মাটিতে হামলার এটাও একটা কারণ হতে পারে।