রেলের বড় দুই প্রকল্প স্থগিত

তাওহীদুল ইসলাম
২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রেলের বড় দুই প্রকল্প স্থগিত

বাংলাদেশ রেলওয়ের বড় দুটি প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম কর্ডলাইন, অন্যটি বিকল্প হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ। এ দুই প্রকল্পের বিশদ নকশাসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলছিল। কিন্তু পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখতে প্রকল্প পরিচালককে (পিডি) নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটি কর্ডলাইন করতে হলে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা দরকার। এ মুহূর্তে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তুতি নেই। তাই প্রকল্পের চলমান কার্যক্রম স্থগিত করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সমান্তরালে আরেকটি সেতু নির্মাণের সমীক্ষা চলছিল। কিন্তু ওই স্থানে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যুৎকেন্দ্রের টাওয়ারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। একই পথ দিয়ে গেছে বিদ্যুৎসংযোগও। ফলে ব্রিজ নির্মাণ করতে হলে এসব স্থাপনা সরাতে হবে। এতে করে সাময়িক বিদুৎ উৎপাদন বা সরবরাহে বিঘœ ঘটতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় গ্রিডলাইনে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বার্থে বিকল্প হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের সমীক্ষা প্রকল্পটি স্থগিত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, রেল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে আরসিআইপিএফ প্রকল্পের আওতায় ১১টি উপ-প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে দুটির কাজ স্থগিত করার নির্দেশনা পেয়েছি। এগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জ থেকে লাকসাম/কুমিল্লা পর্যন্ত কর্ডলাইন এবং বিদ্যমান হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সমান্তরালে নতুন ব্রিজ নির্মাণে সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা।

জানা গেছে, রেল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে সুবিধাদি প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় এডিবির অর্থায়নে এসব কার্যক্রম চলছিল। ১১টি উপ-প্রকল্প নিয়ে চলমান এ কারিগরি প্রকল্পের প্রথমটি হচ্ছে- বিদ্যমান হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সমান্তরালে নতুন ব্রিজ নির্মাণে বিশদ নকশা প্রণয়নসহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা। ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব করে। ১৯০৯ সালে সেতু নির্মাণের সমীক্ষা শুরু হয়। ২৪ হাজার শ্রমিক দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৫ সালে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করে। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। তার নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১ শত ৬৪ টাকা। ১০৯ বছরের পুরনো সেই সেতুটি অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই নতুন করে আরেকটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় কারিগরি প্রকল্পের অধীনে সমীক্ষা কার্যক্রম চলমান। কিন্তু নতুন করে সেতু নির্মাণে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেম ও গ্যাস ট্রান্সমিশন সিস্টেম। এ নিয়ে পিজিসিবির কর্মকর্তাদের নিয়ে মাঠ পরিদর্শন ও বৈঠক করা হয়েছে। গত ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি দুদিন মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনের পর অ্যালাইনমেন্ট বরাবর বৈদ্যুতিক স্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈদ্যুতিক লাইন ও ভোল্টেজ নিয়ে কথা হয় উভয় পক্ষের। একই পথে গ্যাসলাইনও রয়েছে। জিটিসিএল নিয়ে মাঠ পরিদর্শন করেন সংশ্লিষ্টরা গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের সরঞ্জামাদি স্থানান্তর বড় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেজেন্টশনের আয়োজন করা হয়। সেখানে রেলপথমন্ত্রী, রেল সচিব ও রেলওয়ের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে প্রকল্পের বিদ্যমান অবস্থা তুলে ধরলে নতুন করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণের কার্যক্রম স্থগিত করতে নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় সংশ্লিষ্টদের বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেতুর কারণে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই বিদ্যমান সেতুটি আপাতত সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

একই বৈঠকে স্থগিত করা হয়েছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রেলপথের কর্ডলাইন নির্মাণ প্রক্রিয়া। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কুমিল্লা কিংবা লাকসাম ধরে কর্ডলাইনটি হওয়ার কথা। এ জন্য গৃহীত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশার মাধ্যমে রুট চূড়ান্ত হওয়ার কথা। কর্ডলাইন প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ রেলপথটি নির্মিত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে সময় সাশ্রয় হবে প্রায় দুই ঘণ্টা; দূরত্ব কমবে ৯০ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটির দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত রুটে দাঁড়াবে ২২৪-২৪০ কিলোমিটার। কর্ডলাইনের জন্য চারটি রুট ধরা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে- শ্যামপুর-সোনারগাঁও-তিতাস-দেবিদ্বার-বুড়িচং-কুমিল্লা। ৮০ কিলোমিটার এ পথটি হবে মেঘনার পশ্চিম তীরের বাণিজ্যিক এলাকা এড়িয়ে। এটি বিদ্যমান মহাসড়কের ৪-১০ কিলোমিটার উত্তরে। আরেকটি পথ হচ্ছে মহাসড়কের ২-৩ কিলোমিটার উত্তর দিয়ে। শ্যামপুর-সোনারগাঁও-তিতাস-দেবিদ্বার-বুড়িচং-কুমিল্লা। এর বাইরে বিকল্প আরেকটি পথ শ্যামপুর-সোনারগাঁও-তিতাস-ইলিয়টগঞ্জ-চান্দিনা-কুমিল্লা। এটি পদুয়ার বাজারের দক্ষিণের পথ ধরে যাবে মহাসড়ক থেকে দুই থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর দিয়ে লালমাই পাহাড় হয়ে এবং যুক্ত হবে পদুয়ার বাজারের দক্ষিণের রেলপথে। আরেকটি পথ ধরা হয়েছে ৮৯ কিলোমিটারের। সেটি যাবে শ্যামপুর-সোনারগাঁও-তিতাস-মহিচাইল-বরুড়া-লাকসাম দিয়ে। এর মধ্যে প্রথমটির নির্মাণ খরচ হবে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় নির্মাণে গুনতে হবে ৫১ হাজার কোটি টাকা, তৃতীয়টির ক্ষেত্রে ৫৪ হাজার কোটি টাকা এবং চতুর্থ অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী নির্মাণ খরচ পড়বে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ ব্যয় বিবেচনায় আপাতত প্রকল্পটির কাজ স্থগিত করার কথা জানা গেছে। এরপর রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেওয়ার পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকেও তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে রেল কর্মকর্তারা বলছেন, মূল প্রকল্পের কাজ পরে করলেও চলমান সমীক্ষা ও ডিজাইনের কাজ শেষ করা যেত। প্রকল্পের চলতি পথে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে খরচ আরও বাড়বে। আর গুরুত্ব বিবেচনায় প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে। সে কারণেই দাতা সংস্থা এডিবির অর্থায়নে কার্যক্রম চলছে।

তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা তুলে ধরেন ভিন্ন যুক্তি। তার মতে, সমীক্ষা কার্যক্রম শেষে এখনই নির্মাণকাজ শুরু করতে না পারলে লাভ নেই। কারণ প্রস্তাবিত অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী ভবিষ্যতে প্রকল্পটি করা নাও যেতে পারে। নতুন করে স্থাপনা কিংবা অন্য কোনো সমস্যার কারণে এমনটি হতেই পারে। তা ছাড়া পরবর্তীকালে নকশায় ফের সংশোধনের প্রয়োজন হবে। বৃদ্ধি পেতে পারে প্রাক্কলিত ব্যয়ও।