যৌক্তিক মূল্যে বাঁধা যাচ্ছে না বাজার

রেজাউল রেজা
২৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
যৌক্তিক মূল্যে বাঁধা যাচ্ছে না বাজার

এ বছর পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে অনেক আগেভাগেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে বাজার। নিত্যপণ্যের বাড়তি মূল্যের চাপে নাজেহাল ভোক্তা। এমন পরিস্থিতিতে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রুখতে উৎপাদন-ব্যয় বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ২৯টি নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু আশাহত হতে হয়েছে ভোক্তাদের। কারণ, দাম নির্ধারণের পর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ২৯টি পণ্যের মধ্যে হাতে গোনা দুএকটি পণ্য ছাড়া সবই বেশি বা অযৌক্তিক দামেই বিক্রি হচ্ছে।

গত ১৫ মার্চ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে ২৯ পণ্যের যৌক্তিক মূল্যতালিকা প্রকাশ করে। এতে জানানো হয়, কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ এর ৪ (ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- মুগ ডাল, মাষকলাই, ছোলা, মোটা ও উন্নত দানার মসুর ডাল, খেসারি ডাল, পাঙ্গাশ মাছ, কাতল মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, ব্রয়লার মুরগি, সোনালি মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনা মরিচ, কাঁচামরিচ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন, শিম, আলু, টমেটো,

মিষ্টি কুমড়া, খেজুর, চিড়া, কলা ও বেসন। উৎপাদক, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ে এগুলোর দাম নির্ণয় করা হয়েছে। এ দাম অনুযায়ী পণ্য বিক্রি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করবে বলেও সে সময় জানায় সংস্থাটি।

রাজধানীর গতকালের বাজারচিত্র বলছে- দেশি পেঁয়াজ, ডিম ও কাঁচা মরিচের মতো হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য যৌক্তিক দামের কাছাকাছি দামে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য পণ্য এখনো বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ছোলার যৌক্তিক মূল্য ৯৮ টাকা ৩০ পয়সা। অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে কম বেশি ১১০ টাকা। মোটা দানার মসুর ডাল ১০৫ টাকা ৫০ পয়সার বদলে ১১০ টাকা, মুগডাল ১৬৫ টাকার বদলে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। শুকনা মরিচের সর্বোচ্চ দাম ৩২৭ টাকা বলা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। এক কেজি গরুর মাংসের সর্বোচ্চ ন্যায্য মূল্য ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সা উল্লেখ করা হলেও বেশিরভাগ দোকানে বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা দরে। এর কমেও পাওয়া যাচ্ছে যেখানে, সেখানে মানের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। ব্রয়লারের দাম ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। পাঙ্গাশ মাছের কেজি ১৮০ টাকার বদলে বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকার আশপাশে।

রসুনের কেজি ১২০ টাকার বদলে ২২০ টাকা পর্যন্ত এবং আদা ১৮০ টাকার বদলে ২৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি চিড়ার ন্যায্যমূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ৬০ টাকা। অথচ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত।



এছাড়া বেগুন ৪৯ টাকা ৭৫ পয়সার বদলে ৬০-৯০ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা ২০ পয়সার বদলে ৬০-৮০ টাকা, শিম ৪৮ টাকার পরিবর্তে ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে খেজুর ও বেসনসহ অন্যান্য পণ্যও যৌক্তিক নয়, অযৌক্তিক দামে বিক্রি হচ্ছে।

তবে দেশি পেঁয়াজ যৌক্তিক দামেই (৬৫ টাকা ৪০ পয়সা) বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে নয়, সরবরাহ বাড়ায় দাম কমেছে পেঁয়াজের। অন্যদিকে কাঁচামরিচের ন্যায্যমূল্য ৬০ টাকা ধার্য করেছে অধিদপ্তর। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে প্রতি পিস ডিমের যৌক্তিক দাম ১০ টাকা ৪৯ পয়সা। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা দরে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির সুযোগে অতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। সরকারের নানা ইতিবাচক পদক্ষেপেও মিলছে না সুফল; অসহায় হয়ে পড়ছেন ভোক্তারা।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, একই চিত্র বারবার ঘুরে-ঘুরে আসছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় পণ্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজারে তা মানা হয়নি। এবারও বেঁধে দেওয়া মূল্যের ২৯টি পণ্যের ক্ষেত্রে একই চিত্র দৃশ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তারা অনেক অসহায় হয়ে পড়েছেন।

এসব যৌক্তিক মূল্য যাচাই, মূল্য নির্ধারণ, আইন কিংবা হুমকি-ধমকিতে কাজ হবে না। নীতিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে সর্বাগ্রে। সরবরাহ ব্যবস্থা আরও উন্নত করার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে ২৯ পণ্যের বিষয়ে রাজধানীর মালিবাগ বাজারের মো. মোকাদ্দেস হোসেন, কদমতলীর মো. মিলন হোসেন ও রায়েরবাজারের সেন্টু মিয়াসহ আরও কয়েক খুচরা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তারা সবাই জানান, মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি তারা জানেনই না! আবার অনেকে জানিয়েছেন, বিষয়টি জানা থাকলেও কোনো কোনো পণ্যের দাম কত নির্ধারণ করা হয়েছে সে বিষয়ে ধারণা নেই। আবার একেক ব্যবসায়ী বলছেন একেক মূল্যের কথা।

যৌক্তিক মূল্য ও নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট উৎপাদকরা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলছেন, কৃষি বিপণনের বেঁধে দেওয়া ‘যৌক্তিক মূল্য’ আসলে ‘অযৌক্তিক’। এ ধরনের কল্পনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফলে সরকার ও ব্যবসায়ী উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পণ্যমূল্যে ৬১, ৮৭, ৪৯ পয়সা নির্ধারণ ‘অবাস্তব’। ব্যবসায়ীরা ১ পয়সা কোথায় পাবে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার আমাদের সময়কে বলেন, ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৪৫ টাকা ৭৮ পয়সা ও ডিমের ৮ টাকা ৮১ পয়সা- এ তথ্য তারা কোথা থেকে পেলেন, জানি না। আমাদের প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে তারা আলোচনা করেননি। এ ধরনের অবাস্তব হিসাবের ফলে ভবিষ্যতে বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেনও বলেন, আমরা যারা উৎপাদনকারী, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব দেয়নি। তারা মাংস বিক্রয়কারী ও প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে। তাছাড়া তারা যখন এটা করেছেন, তখনকার চিত্র আর বর্তমান চিত্র এক নয়। ফলে ধার্যকৃত উৎপাদন-ব্যয় ও মূল্য নির্ধারণ বাস্তবসম্মত হয়নি। তাই বাস্তবায়নও সম্ভব হচ্ছে না।

তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, উৎপাদন খরচ ও নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য সম্পূর্ণ সঠিক। যথাযথ প্রক্রিয়া ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনেই এটা তৈরি করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া দামের প্রভাব বাজারে পড়ছে না কারণ ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের প্রবণতা থেকে বের হতে পারছেন না। তাই তারা এটা মানতে চাইছেন না।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাসুদ করিম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের মাঝে বেশি মুনাফা করার প্রবণতা রয়েছে। সে কারণে তারা এই যৌক্তিক মূল্য মানতে চাইছেন না। মাঠপর্যায়ে উৎপাদক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করে এটা তৈরি করা হয়েছে। এ হিসাব সম্পূর্ণ সঠিক। তবে বাজারে এখনো এর প্রভাব পড়েনি, ঠিক। একটু সময় লাগবে। ইতোমধ্যে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচের মতো কয়েকটি পণ্যের দাম কমে এসেছে। তাছাড়া এটার ফলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এখন এসব পণ্যের যৌক্তিক মূল্য সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে কাজ করতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি বলেন তারা যৌক্তিক মূল্যের বিষয়টি জানেন না, তবে তা ভুল। আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেছি। তাছাড়া মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি বিভিন্ন পর্যায়ে জানানো হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোতেও উঠে এসেছে। এরপরও তারা কেন বলেন যে, এ বিষয়ে জানেন না, তা তারাই ভালো জানেন।

এদিকে বাজারে গিয়ে নির্ধারিত দামে পণ্য না পেয়ে হতাশ সাধারণ ভোক্তারা। কদমতলী এলাকার বাসিন্দা মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, কিছু দিন পর পর কেবল খবরেই শুনতে পাই-দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজারে সে দামে পাই না। আসলে দাম বেঁধে দিয়েই দায় সারা হচ্ছে। বাজারে কার্যকর তদারকি না থাকায় ভোক্তারা উপকৃত হচ্ছেন না।

নির্ধারণ করে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার। কিন্তু ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার এক সপ্তাহ পার হলেও সেভাবে মনিটরিংয়ের বিষয়টি দৃষ্টিগোচরে আসছে না।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম বলেন, জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে তদারকি শুরু হয়েছে। তাছাড়া আমাদের নিয়ে অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে এখনো কোনো সাড়া পাইনি। নির্ধারিত মূল্য মানা হচ্ছে কিনা, পর্যায়ক্রমে তা সকল ধাপেই তদারকি করা হবে।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, যারা মূল্য নির্ধারণ করেছে তাদেরই মনিটরিং করার যথেষ্ট লজিস্টিকস রয়েছে। কৃষিপণ্যের বাইরেও আমাদের অনেক কিছু দেখতে হয়। আমাদের জনবলও অনেক কম। আমরা ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষায় সব পণ্যেই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি।

এদিকে ‘যৌক্তিক মূল্য’ ও ‘নির্ধারিত মূল্য’ সম্পূর্ণ পৃথক দুটি বিষয় বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যৌক্তিক মূল্য যাচাই করেছে। এটাকে মার্কেটিংয়ের ভাষায় ‘রেফারেন্স প্রাইস’ বলা হয়। তারা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়নি। সুতরাং এ দুটোকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। রেফারেন্স প্রাইসের ওপর ভিত্তি করে ক্রেতা ও ব্যবসায়ী পণ্যটির যৌক্তিক মূল্য সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। পাশাপাশি এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সরকারের অন্য সংস্থাগুলো তাদের পদক্ষেপ নিতে পারবে। তবে আগেও বলেছি, এ ধরনের কৃষিপণ্যের যৌক্তিক দাম বা মূল্য নির্ধারণ করে তা প্রকাশ করা উচিত হয়নি। এটা যাচাইয়ের পর বাজারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।