জ্বলে কিন্তু ফলে না

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
জ্বলে কিন্তু ফলে না

২০১৮ সালে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান বা যুদ্ধ। সেই অভিযান চলাকালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় কয়েকশ মাদক কারবারি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানও এক সময় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ধরা পড়েন অনেক রাঘববোয়াল। গত তিন বছরে অন্তত চারবার অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলে। সিলগালা করে দেওয়া হয় অনেক প্রতিষ্ঠান। ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে গত বছর সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে চালানো হয় বিশেষ অভিযান। সর্বশেষ, বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর রাজধানীর বহুতল ভবনসহ অবৈধ স্থাপনা ও হোটেল রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে সরকারের একাধিক সংস্থা। অভিযানে হাজারখানেক মানুষকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিভিন্ন সময় বিশেষ অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

কিন্তু এসব অভিযান বা যুদ্ধ কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে? দেশে মাদকের কারবার কি কমেছে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমেনি বরং বেড়েছে। ক্যাসিনো বা জুয়াও বন্ধ হয়নি। অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের কারবারও চলছে দেদার। ঢাকা এখনো বায়ুদূষণে বিশে^র এক নম্বর শহরের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে। অভিযানের পর অভিযান চললেও ঝনঝনানি কমেনি অবৈধ অস্ত্রের।

একটি ইস্যু নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ার পর জ¦লে ওঠে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দপ্তর। শুরু হয় বিশেষ অভিযান। কিন্তু দিন যত যেতে থাকে, ততই কমে যেতে থাকে অভিযানের তোড়জোড়। এরপর একসময় পুরোপুরি থেমে যায়; ফলপ্রসূ হয় না। বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর চলা অভিযান কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, তা নিয়েও যথারীতি প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আলোড়িত কা-ের পর তোড়জোড় করে চালানো অপরিকল্পিত অভিযানে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল আসে না। বরং এসব অভিযানকে ‘লোক দেখানো’ মনে করেন তারা। বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে জনগণের বাহবা পেতে এসব অভিযান চালানো হয়। সফলতা পেতে হলে লোক দেখানো অভিযান নয়, যেতে হবে সমস্যার মূলে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক কারবারি, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অবৈধ অস্ত্রধারী, পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার পুলিশের নিয়মিত কাজ। তবে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিশেষ অভিযান চালানো হয়। আবার অগ্নিকা- কিংবা দুর্ঘটনার পরও বিশেষ অভিযান চলে। বিভিন্ন সময় পরিকল্পনা করে অভিযান চলে। আবার রাজনৈতিক চাহিদা ও জনগণের চাপেও এসব অভিযান চলে। তবে এসব অভিযান জোরালোভাবে শুরু হলেও একটা সময় গতি হারায়। অনেক সময় ঊর্ধ্বতনদের তদারকি ও আগ্রহও কমে যায়। কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের চাপ থাকে। আবার নতুন কোনো ঘটনা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও আগের ইস্যুতে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে পরস্পর দোষারোপ কিংবা দায় চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে লোক দেখানো অভিযান কোনো পরিবর্তন আনবে না। অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে কারও পরিচয় বা প্রভাব বিবেচনা না করে সৃষ্ট অনিয়ম, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা নিরসনে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করতে পারলে পরিবর্তন সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ঘটনা-পরবর্তী অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিংবা মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দেওয়ার নামে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর সুফল সাধারণ মানুষ পায় না। বরং কোনো স্বার্থান্বেষী মহল এ ধরনের অভিযান থেকে নতুন কোনো দুর্নীতি বা আর্থিক লেনদেনের সুযোগ খুঁজতে পারে।

পুলিশের সাবেক আইজি একেএম শহীদুল হক বলেন, যখন অভিযান হয় তখন কিছুটা ফলপ্রসূ হয়। তবে এসব অভিযানের সঙ্গে লজিস্টিক সাপোর্ট এবং অন্যান্য অনেক বিষয় জড়িত। অভিযান এভাবে চলতে থাকলে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। এসব কারণে অভিযানের সময় ভালো ফল পাওয়া

গেলেও পরে অবনমন হবেই। যুদ্ধের পরও মাদকের বিস্তার : ‘চল যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে ২০১৮ সালের ৪ মে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) যৌথ অভিযানে শুধু কক্সবাজারেই ২৯৯ জন নিহত হন। কিন্তু মাদক নির্মূলে এই সর্বাত্মক অভিযানের পাঁচ বছরের মাথায় পরিসংখ্যান বলছে, ইয়াবাসহ মাদকের সরবরাহ ও জব্দ বেড়েছে কয়েকগুণ। পাঁচ বছরে মাদকসংক্রান্ত মামলা ও আসামি গ্রেপ্তারও দ্বিগুণ হয়েছে। এ ধরনের সর্বাত্মক অভিযান মাদক প্রতিরোধ ও সরবরাহে তেমন বড় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং এ সময়কালে আইস, এলএসডি, ডিওবি, খাট, ম্যাজিক মাশরুম ও কালো কোকেনসহ নতুন নতুন মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বৈচিত্র্যময় মাদকের অনুপ্রবেশ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে তারা হেরোইন উদ্ধার করে ১৩ কেজি ৩০ গ্রাম আর ইয়াবা উদ্ধারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৩টি। পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালে হেরোইন উদ্ধার হয়েছে ৩১ কেজি ১৭ গ্রাম এবং ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে ৫২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৩ পিস। ২০১৮ সালে ১৩ হাজার ৭৯৩ মামলায় আসামি ছিল ১৫ হাজার ১১৬ জন। কিন্তু ২০২৩ সালে ২৭ হাজার ৯৯১ মামলায় আসামি ২৯ হাজার ৭৭৩ জন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, মাদকবিরোধী সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী ফলপ্রসূ হয়নি। তবে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন হয়েছে। এখন আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক যুদ্ধের দিকে মনোযোগ দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা সৃষ্টির কাজ জোরদার করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিযান, ক্রসফায়ার ও নির্যাতন করে দেশকে মাদকমুক্ত করা যাবে না। সর্বাধিক প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

গতিহারা স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযান : বিভিন্ন সময় অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সপ্তাহ না ঘুরতেই গতি হারায় সেই অভিযান। ২০২০ সালে তোড়জোড়ে শুরু করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালের ২৫ মে আকস্মিক ঘোষণা দিয়ে অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই অভিযানও গতি হারায়। আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে অবৈধ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো। চলতি বছরেও লাইসেন্সবিহীন অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। সপ্তাহখানেক অভিযান চলে। তবে স্বাস্থ্য খাতের সেবার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বর্তমানে অভিযানই বন্ধ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন তদারকি প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও সংঘবদ্ধ প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে।

ফলপ্রসূ হয়নি রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অভিযান : রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ৪৬ জন নিহতের পর জোরালো অভিযান শুরু করে রাজউক ও পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। অভিযানের ফলে রাজধানীর রেস্তোরাঁর একটি অংশ বন্ধ হয়ে যায়। মালিকরা পালিয়ে থাকলেও তিনদিনে ১৩৪৭ প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ৮৭২ জনকে গ্রেপ্তার ও ৮৮৭টি প্রসিকিউশন দেওয়া হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকাংশই কর্মচারী। সপ্তাহ না ঘুরতেই ডিএমপির অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। রাজউক ও সিটি করপোরেশনের অভিযানও গতিহারা।

এদিকে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ঢালাও অভিযানের মাধ্যমে রেস্তোরাঁ ব্যবসা ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। তৈরি হচ্ছে নতুন চাঁদাবাজির ক্ষেত্র। লোক দেখানো অভিযানে হয়রানি বাড়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি ঘটনা ঘটার পর দায়সারা অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। এটা করতে হবে পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে। অভিযানের আগে ভবনগুলো কী অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে জরিপ করে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে।

বায়ুদূষণ রোধে বিশেষ অভিযান : গত বছর বিশ্বে বায়ুদূষণে শীর্ষ শহরের তালিকায় জানুয়ারিজুড়ে ঘুরেফিরে এসেছে ঢাকার নাম। প্রতিদিনই বিষভরা বাতাস শ^াস-প্রশ^াসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর বিশেষ অভিযান শুরু করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভিযানের কোনো ফল আসেনি। অভিযানের পরও ঘুরেফিরে বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকার নাম উঠে আসে।

মশা নিধনে বিশেষ অভিযান : ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ঢাকার দুই সিটি কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে বিশেষ অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে জরিমানা করেই দায় সারে। কিন্তু এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ফলে অভিযানের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

এমন আরও অনেক ইস্যু রয়েছে, যা নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ার পর বেশ ঘটা করে শুরু হয় অভিযান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব অভিযান ফলপ্রসূ হয়নি।