রেলে চলছে পকেট ভারী করার মচ্ছব

তাওহীদুল ইসলাম
১৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রেলে চলছে পকেট ভারী করার মচ্ছব

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রেল খাতের উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে লাখ কোটি টাকারও বেশি; নতুন নতুন রেলরুট ও ইঞ্জিন-বগি কেনাকাটায় নজর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং লোকোমোটিভ-কোচ মেরামতে বরাবরই ছিল কর্তৃপক্ষের অবহেলা। তারা কেবল নতুন নতুন প্রকল্পে আগ্রহী। অথচ রেলওয়ের অধিকাংশ লোকোমোটিভেরই আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে; অধিকাংশ রেলপথই ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি হলেও এদিকে মন নেই রেলের কর্তাব্যক্তিদের। এ ছাড়া সময়মতো ট্রেন চালনা রেলের অন্যতম কাজ। এ কাজেও গুরুত্ব কম। ঝোঁক বেশি কম দরকারি প্রকল্পে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রেলে পকেট ভারী করার মচ্ছব চলছে। আর এ কারণেই কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায় রেললাইন বেঁকে চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী ‘বিজয় এক্সপ্রেস’ ট্রেনের ৯টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা। গতকাল দুপুরে এ লাইনচ্যুতির ঘটনায় ট্রেনটির অন্তত ১০ যাত্রী আহত হয়েছেন। এর পর চট্টগ্রামের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধের সংবাদ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চতাপে ইস্পাতের তৈরি রেললাইন সম্প্রসারিত হয়। নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হলে জোড়ার স্থানগুলোতে রেললাইন বেঁকে যেতে পারে। ট্রেন চলাচলের সময় চাকার সঙ্গে রেললাইনের ঘর্ষণেও তাপ উৎপন্ন হয়। ফলে অতি তাপে লাইন বেঁকে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কোথাও বাঁক তৈরি হয়েছে কিনা, তা দেখতে রেললাইন পরিদর্শনের কথা। যেসব এলাকায় লাইন দুর্বল, সতর্কতার সঙ্গে ট্রেন চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতি কমিয়ে কত হবে তা লাইন ও ট্রেনের অবস্থার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন লোকোমাস্টার (চালক)। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে রেলপথ লাইনচ্যুত হয়েছে এমনটি মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দুর্ঘটনাকালে তাপমাত্রা তত বেশি ছিল না, যাতে রেললাইন সম্প্রসারিত হতে পারে। বরং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই এমনটি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

কী কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছেÑ এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলছেন, বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। আশা করি, তদন্তেই রহস্য উদ্ঘাটন হবে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, রেল বেঁকে যাওয়ার ঘটনাটি অস্বাভাবিক। তাপমাত্রার কারণে মনে করছি না। দেখতে হবে কোন লাইনে ঘটনাটি ঘটেছে। নতুন নাকি পুরনো রেলপথ। দেখেছি বগি লাইনচ্যুতি। লোকোমোটিভের কিছু হয়নি। শান্টিং অ্যান্ড কাপলিং যথাযথ ছিল কিনা অথবা যুক্ত-হুকটির মেরামত সঠিক ছিল না দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, রেলের উন্নয়ন একমুখী। কেবল নতুন নতুন প্রকল্পে আগ্রহী কর্তাব্যক্তিরা। অথচ রেলওয়ের ৭০ শতাংশ লোকোমোটিভ আয়ুষ্কাল পার করেছে। ৬৩ শতাংশ রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।

জানা গেছে, দেশে রেলওয়ের তিনটি মেরামত কারখানা রয়েছে। সৈয়দপুর, পার্বতীপুর ও পাহাড়তলী। এসব কারখানায় একদিকে জনবলের অভাব, অপরদিকে যন্ত্রাংশ ও বরাদ্দের অভাব। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কারখানার মঞ্জুরি পদ ২২৫৫টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ৯৮৫ জন। তার মানে ১২৭০টি পদ শূন্য। ৫৬.৩২ শতাংশ শূন্য পদ দিয়ে কারখানা চালানোর কারণে সময়মতো মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয়ে ওঠে না।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা গেছে, জনবলের ঘাটতি, অপ্রতুল বাজেট, সময়মতো যন্ত্রাংশ/কাঁচামাল সরবরাহ না করা, পুরনো/জরাজীর্ণ প্ল্যান্টস ও মেশিনারিজের কারণে টার্গেট অনুযায়ী মেরামত করা যাচ্ছে না। মেরামত ও সংরক্ষণ খাতে চাহিদা ছিল মাত্র ৭০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর বিপরীতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) চাহিদা ৬৬ কোটি। এ পর্যন্ত বরাদ্দ মিলেছে মাত্র ১৯.৫০ কোটি টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারখানাটিতে জনবল অনেক কম। বিশেষ করে এসএসই/এসএই/সুপারভাইজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রায় ৮৬ শতাংশই শূন্য। দক্ষ ক্যাটাগরিতে ৫৮ শতাংশ এবং আধাদক্ষ ক্যাটাগরিতে ৫৬ শতাংশ জনবল ঘাটতি আছে। একই অবস্থা সৈয়দপুর ও পার্বতীপুর কারখানাতেও। রেলে কারখানায় জনবল ও অর্থবরাদ্দে অনীহার বড় কারণ কেনাকাটা। নতুন রেলপথ তৈরি ও লোকোমোটিভ-কোচ কেনা মানেই প্রকল্প। বিদেশ সফর, গাড়ি হাঁকানো সব শেষে পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে কমিশন। এ জন্য চড়া সুদও গুনতে হচ্ছে রেলকে। আবার কেনার পর দেখা যায়, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী লোকোমোটিভ বা কোচ আসেনি। কমিশন বাণিজ্যের লোভে এসব ট্রেনকেই অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে দেখা যায় নানা ত্রুটি। তখন আবার যন্ত্রাংশ কেনার জন্য বিকল্প প্রকল্প। এ কারণে রেলের নিজস্ব কারখানার সক্ষমতা বাড়ানো হয় না। রেলপথ মানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের প্রকল্প। আর রোলিং স্টকে আছেন মেকানিক্যাল বিভাগের কর্মকর্তারা। এমন বাস্তবতায় রেলের উন্নয়নে কারখানা স্থাপনে জোর দিতে বলা হয়েছে।

রেলওয়ের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০৪৫ সালের মধ্যে সব ট্রেন ব্রডগেজে রূপান্তর করবে রেলওয়ে। তাহলে ১১৬৫টি মিটারগেজ ট্রেনকে ব্রডগেজে রূপান্তর করতে হবে। আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ উদ্বোধনের পরও ট্রেন চালানো যাচ্ছে না প্রায় একই কারণে। ভবিষ্যতে পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আরও যাত্রীবাহী ট্রেন চালনার সম্ভাবনা রয়েছে। মিটারগেজের ট্রেনকে ব্রডগেজের ট্রেনে রিপ্লেসমেন্ট, পুরনো কোচ বাতিল, ভারতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনÑ এসব কারণে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এক হাজারটি কোচ কিনতে হবে। অর্থাৎ প্রতি বছরে প্রায় ১০০টি করে দরকার। রেলওয়েতে বর্তমানে কোচ মেরামতের জন্য দুটি কারখানা রয়েছে। এই দুটি কারখানার বিদ্যমান কোচই মেরামতের সক্ষমতা হারিয়েছে। এখানে কোচ তৈরির অবস্থাও নেই। অথচ নতুন কোচ তৈরি করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশ রেলওয়ে নতুন কোচ উৎপাদন করে দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারে। উপরন্তু পাশর্^বর্তী দেশে রপ্তানি করতে পারবে।

দেশে মোট যাত্রীর মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ রেলে চলাচল করেন। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ হার ছিল ৩০ শতাংশ। একই সঙ্গে মোট পণ্য পরিবহনে রেলের অবদান ২৮ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয় ছিল ৫৬১ কোটি টাকা। যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন করে এই আয় করেছে রেল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১৭৮৩ কোটি টাকা। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পরিচালন ব্যয়ও।

গত এক দশকে রেলে বিস্তর বিনিয়োগ হলেও এখনো পুরনো ইঞ্জিন-কোচ, নড়বড়ে রেলপথ, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, লোকবল সংকট, যাত্রীসেবায় অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত রেলওয়ে। বিপুল অর্থ খরচ করে তৈরি করা রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা তুলনামূলক কম।

বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন আসা-যাওয়ায় বিলম্বের ঘটনা বেড়েছে। গতকালের লাইনচ্যুতির ঘটনায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ দীর্ঘসময় বন্ধ থাকায় রোজার মাসে যাত্রীদের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। যাত্রাবিলম্ব ঘটে নানা কারণে। ইঞ্জিন ফেইলিওর, রেলপথের রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি, কোচের ত্রুটি, চালকের দুর্বলতাসহ নানা কারণ আছে। যে কারণেই ঘটুক, লোকোমোটিভ-কোচ কেনায় অনিয়ম ও কমিশন বাণিজ্যের তদন্ত করছে দুদক। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তনসহ নানা ঘটনাই ঘটেছে রেলে। ২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনে রেলওয়ে। এগুলো সরবরাহের কাজ পায় ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা কোম্পানি। ট্রেনের কোচ কেনায় ঘুষ লেনদেন এবং অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে মাঠে নেমেছে দুদক।