বুলিংয়ের বিচার না পেয়ে অবন্তিকার আত্মহনন
উত্তাল জবি ক্যাম্পাস
‘আমার ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছে করে না, দম বন্ধ লাগে’- কদিন আগে বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনকালে বলেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা। এরপর গত শুক্রবার রাতে নিজ বাড়িতে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। জানা গেছে, এর আগে দুবছর ধরে কয়েকজন সহপাঠী দ্বারা ক্রমাগত বুলিংয়ের (তর্জন-গর্জন বা গুণ্ডামি) শিকার হয়েছিলেন এই মেধাবী শিক্ষার্থী। প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও বিচার পাননি। এমনটাই দাবি অবন্তিকার পরিবার ও কাছের সহপাঠীদের। আত্মহত্যার আগে অবন্তিকা তার ফেসবুক পোস্টেও এ নিয়ে আক্ষেপ করে গেছেন। সেই পোস্টে তিনি সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যান।
অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল উত্তাল ছিল জবি ক্যাম্পাস। সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে এ কাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি তুলেছেন বিক্ষুব্ধরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও গতকাল বিচার দাবি করে বিক্ষোভ করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি। এদিকে গতকাল শনিবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান জানান, সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। তারা এখন পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। যদিও গোয়েন্দারা এ দুজনকে কখন, কোত্থেকে হেফাজতে নিয়েছেন, তা জানাননি। সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লা পুলিশের একটি দল ঢাকার পথে রয়েছে। আটক এ দুজনকে তাদের কাছে হস্তান্তর করবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কুমিল্লার পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বলেছেন, আমাদের একটি টিম ডিএমপির সঙ্গে কাজ করছে। গতকাল রাতে তিনি জানান, ইতোমধ্যেই মামলাও হয়েছে।
এদিকে, ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুর ১টার দিকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাগিচাগাঁওয়ের বাসার সামনে আনা হয় অবন্তিকার মরদেহ। বিকাল ৩টায় কুমিল্লা সরকারি কলেজ মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অবন্তিকার বিভাগের সহপাঠীরা ছাড়াও স্থানীয় বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেন। এরপরই বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয় তাকে। ফাইরুজ অবন্তিকা কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিস পুকুরসংলগ্ন একটি ভাড়া বাসায় মা ও ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। তিনি কুমিল্লা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক প্রয়াত জামাল উদ্দিনের কন্যা। নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
জবি প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায়, দুবছর আগে অভিযুক্ত আম্মানসহ বিভাগের কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে অবন্তিকার। প্রক্টর অফিসের মধ্যস্থতায় এর সমাধানও হয়। তবে গত বছরের নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে একটি অভিযোগপত্র দেন অবন্তিকা। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, সহপাঠী আম্মান ও তার বন্ধুরা ক্লাসে তাকে নানাভাবে হয়রানি ও বিরক্ত করত।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পরিবারের অভিযোগ, অবন্তিকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। তার ক্যাম্পাস জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, জানান অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বারবার জানিয়েও হয়রানির বিচার পাননি তারা। এ কারণেই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাহমিনা শবনম বলেন, আমার মেয়েকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আম্মান, রাফি, মাহিয়ান, লাকি, রিমি, আঁখি, বন্যা ও দ্বীন ইসলাম আমার মেয়ের জীবনটাকে বিষিয়ে তুলেছিল। তারা বিভিন্নভাবে আমার মেয়েকে হয়রানি করে আজকের অবস্থা সৃষ্টি করেছে। তিনি যোগ করেন, হয়রানির অভিযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে গিয়েও আমার মেয়ে কোনো বিচার পায়নি। উল্টো তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে, অপমান করা হয়েছে। আমার মেয়ে বিচার পেলে আজ তাকে চলে যেতে হতো না। এদিকে সুইসাইড নোটে অবন্তিকা লিখেন প্রথম বর্ষে আম্মান সিদ্দিকী প্রেমের প্রস্তাব করলে আমি প্রত্যাখ্যান করি। এর পর থেকে আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।
ফাইরুজ অবন্তিকাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ হোসেন গণমাধ্যমের কাছে মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধেও। এ বিষয়ে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, অবন্তিকা একটা অভিযোগ দিয়েছিল নভেম্বর মাসে। পরে তাকে ডাকানো হলে সে আর যোগাযোগ করেনি। তাই এ বিষয়ে পরবর্তী সময় আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ভুক্তভোগী দেখা না করলে কি অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় না? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বলেন, আমলে নেওয়া হয়। কিন্তু এর আগে এ অভিযোগের একবার মীমাংসা হয়েছিল বলে সরাসরি তার বক্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। সে আর যোগাযোগ করেনি।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি : অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে এতে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন জবির বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় জবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। এ সময় ৬ দফা দাবি তুলে ধরা হয়- হত্যার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা, অভিযুক্ত আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার, জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করে অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার, ভিকটিমের পরিবারকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা দায়ের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল কার্যকর করা। এসব দাবির মধ্যে, অভিযুক্ত দুজনকে আটক করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন