কুষ্টিয়া পৌর এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট
ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে পদ্মার শাখা নদ প্রমত্তা গড়াই এখন পরিণত হয়েছে ছোট্ট খালে। সেই সঙ্গে অভাবনীয়ভাবে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এর প্রভাবে কুষ্টিয়া পৌর এলাকাসহ এর আশপাশের অর্ধলক্ষাধিক নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির জন্য চলছে হাহাকার। রমজানে পানি সংকট আরও বাড়বে; দুর্ভোগে পড়বে জনগণ- এমনটি আভাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রাকৃতিক এই সমস্যা সমাধানে তাদের কিছুই করার নেই। তবে বৃষ্টি হলে এবং গড়াই নদীতে পানি বাড়লে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
পৌরসভার তথ্যমতে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পৌরসভা কুষ্টিয়া। এর আয়তন প্রায় ৪৩ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৬ জন। পৌর এলাকার ২১টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং সংখ্যা প্রায় ৩৭ হাজার। প্রতিটি বাড়িতেই আছে নিজস্ব নলকূপ। এ ছাড়া পৌরসভার পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় দেওয়া হয়েছে প্রায় ৭ হাজার নলকূপ।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে এসব এলাকার প্রায় সব নলকূপই প্রায় অকেজো। যেগুলো কাজ করছে, সেগুলোতে পানি উঠছে অতি সামান্য। এক বালতি পানি তুলতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগছে। শুধু পৌর এলাকা নয়, শহর সংলগ্ন বারখাদা ইউনিয়ন, হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন, কয়া ইউনিয়ন, চাপড়া ইউনিয়ন, শিলাইদহ ইউনিয়নসহ নদী সংলগ্ন অনেক এলাকায় চলছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
কুষ্টিয়া পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, গড়াই নদের নাব্যতা না থাকায় পানির স্তর বিগত বছরগুলোর তুলনায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ফিট নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। পানি সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা সক্রিয় না থাকায় বিপাকে পড়েছে জনজীবন। এমনকি পৌরসভার পক্ষ থেকে যে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করা আছে, তার উৎপাদনও অনেক কম হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পেছনে যত্রতত্র গভীর নলকূপ
স্থাপনকে দায়ী করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তারা বলছে, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি শুকিয়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। সে ক্ষেত্রে যেসব নলকূপের লেয়ার অল্প থাকে, সেগুলোতে পানি না ওঠারই কথা। নতুন নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক আরও গভীরে লেয়ার দেওয়ার পরামর্শ দেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, উৎসগুলো থেকে আসা পানি নদীতে সংরক্ষণ না করা, বর্ষার সময় ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে আবার সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া পানি সংকটের একটি অন্যতম কারণ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কুষ্টিয়া শহরসহ আশপাশের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বেশির ভাগ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। খাবার পানি সংগ্রহ করতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করে পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায়। খাবার পানি পেতে শহরের অনেকেই শক্তিশালী সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করছেন। সেটা শুধু বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু শহরের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের সুপেয় পানির হাহাকার কমছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে রমজানে সকলের একই সময়ে পানি প্রয়োজন হওয়ায় সুপেয় পানি প্রাপ্তি আরও দুষ্কর হতে পারে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
জানা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে সপ্তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এখানে কৃষিকাজসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। এ ছাড়া পদ্মা ও গড়াই নদের পানি স্বল্পতার কারণে এ বছর চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে এখন যে টিউবওয়েলগুলো থেকে সুপেয় পানি উঠছে, কিছুদিন পর গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে সুপেয় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করবে। ফলে এই এলাকার মানুষের পানির জন্য সৃষ্টি হবে হাহাকার।
কুষ্টিয়া হাউজিং এলাকার গৃহবধূ হাদিসুন্নেছা জানান, গত মাস থেকে তাদের টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবেশী যাদের গভীর নলকূপ আছে তাদের বাড়ি থেকে পানি এনে কোনো রকমে সাংসারিক কাজ চালাচ্ছেন। তাদের টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরশীল ১০ জনের গোসল, রান্না এবং থালাবাসন ও কাপড়চোপড় ধোয়াসহ আনুষঙ্গিক কর্মকা-ে পানি ব্যবহারে চরম সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রমজানে সবার একই সময়ে পানি প্রয়োজন হবে। তখন পানযোগ্য পানি পেতে আরও বেগ পেতে হবে। সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।
কুষ্টিয়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম জানান, পানি সংকটের বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাচ্ছি, কিন্তু আমরা কোনো উপকার করতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা কাউসিলররা কয়েক দফা সভা করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এখন বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
প্রকৌশলী সাবিনা ইসলাম জানান, এ বছর হঠাৎ করেই ভূ-গর্ভস্থ পানির লেয়ার অতি দ্রুত নীচে নেমে গেছে। গভীর নলকূপ ছাড়া সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না। পানির অপচয় না করার জন্য জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যাপারে কুষ্টিয়া পৌরসভা থেকে মাইকিং করা হয়েছে। এরপরও রমজান মাসে কীভাবে পানি সংকট নিরসন করা যায়, সে ব্যাপারে পৌর কর্র্তৃপক্ষ চিন্তা করছে।
কুষ্টিয়া গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী, পানি বিশেষজ্ঞ রাশেদুর রহমান দৈনিক আমাদের সময়কে জানান, এ বছর কুষ্টিয়াতে কৃষি কাজের জন্য অতিমাত্রায় স্যালো টিউবওয়েলে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। পাশাপাশি গড়াই নদের নাব্যতা অনেকাংশে কম। ফলে পানির লেয়ার দ্রুত নীচে নেমে গেছে। এ দুটি কারণেই সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না বলে আমার ধারণা । এখন অপেক্ষা করতে হবে বৃষ্টির পানি আর নদীর পানির বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য। তা ছাড়া সাধারণ নলকুপে পানি পাওয়া যাবে না।