এলোমেলো অভিযান থেকে সরে আসছে সব সংস্থা
রাজধানীর নিউ বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে মর্মান্তিক অগ্নিকা-ের পর নড়েচড়ে বসে সেবা সংস্থাগুলো। নিজেদের দায় ও দায়িত্ব যখন প্রশ্নের মুখে, তখন ভাবমূর্তি উদ্ধারে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন। প্রত্যেকটি সংস্থা আলাদাভাবে রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযানে নামে। এসব অভিযান রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়। এর মধ্যে অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া এবং গ্রেপ্তার ও জরিমানার ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। সাধারণত এ মাসে রেস্তোরাঁগুলোতে চলে ইফতার মাহফিল। এ নিয়ে যখন ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত এবং ভোক্তারাও নিরাপত্তাহীনতায় রেস্তোরাঁ বিমুখ হচ্ছে, তখন জানা গেল, হোটেল-রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে আলাদাভাবে অভিযান পরিচালনা থেকে সরে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্তাগুলো।
অভিযোগ রয়েছে সংস্থাগুলোর পৃথক অভিযানে বাণিজ্যও লুকিয়ে রয়েছে। একই রেস্তোরাঁয় রাজউক অকুপেন্সি সনদ না থাকায় জরিমানা করার পর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অনিরাপদ থাকার অভিযোগে বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। পরে আবার পুলিশের অভিযানে রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে যখন বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়, তখন রাজউকের টনক নড়ে। এবার রাজউকের পক্ষ থেকে অন্যান্য সংস্থাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে আর পৃথক অভিযানে না গিয়ে সবগুলো সংস্থা এক সঙ্গে যেন অভিযানে যায়। আগামী ১৭ মার্চ এ নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন একটা সংস্থা করার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি ১০ মার্চ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ভবন নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের অনুমোদন ও তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বয়ে একটি সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ গঠন করার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। সে সময় আরও বলেন, ‘আমরা শিগগির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে কীভাবে ভবিষ?্যতে একটি প্রোগ্রাম নেওয়া যায়, এ ধরনের অনিয়ম যারা করে তাদের বিষয়ে একটি সংস্থাকে পুরোপুরি দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা, সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে একটা ব?্যবস্থা নেব। সে জন?্য খুব শিগগির আমরা একটা মিটিং করব।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটা অথরিটি চাচ্ছি। হয় ফায়ার সার্ভিস, না হয় রাজউক, না হয় পুলিশের কেউ একজন অথরিটি থাকবে। এ অথরিটি পুরো দায়িত্ব নেবে। সবাই মিলে একটা অথরিটি হবে, সেখানে ফায়ার সার্ভিস থাকবে, মেয়র সাহেবের প্রতিনিধি থাকবে। সবাইকে নিয়ে একটা অথরিটি করার চিন্তা করছি। তবে সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা আমাদের সময়কে বলেন, আমরা ব্যবসা বন্ধ করার পক্ষে নই। ব্যবসা চলবে। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে করতে হবে। রাজউকের টিম যাচ্ছে, সব যাচাই-বাছাই করে দেখবে যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে বন্ধ। যেগুলোর সমস্যা সমাধানযোগ্য, সেগুলোকে সময় দেওয়া হচ্ছে। তবে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে আর পৃথক পৃথক অভিযান নয়, এবার রাজউক-সিটি করপোরেশন-ফায়ার সার্ভিস-জেলা প্রশাসক যৌথভাবে অভিযানে যাবে। অভিযানের উদ্দেশ্য আতঙ্ক সৃষ্টি করা না, ঝুঁকিপূর্ণ কিনা সেটা দেখার জন্যই যাওয়া।
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান আমাদের সময়কে বলেন, চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলেছিলাম। সেই টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় করে অতিঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে কীভাবে ঝুঁকি হ্রাস করা যায়, তার একটা গাইডলাইন প্রস্তুত করার দাবি জানিয়েছি। যাদের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে, তাদের ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে।’
ইমরান হাসান বলেন, নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো ঘাটতি থাকলে সেটি সমাধান করতে যৌক্তিক সময় বেঁধে দেওয়ার দাবি করেছি। কিন্তু সংস্থাগুলো তা না মেনে নিজেদের মতো অভিযান করছে। এতে আমাদের অনেক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী গেপ্তার ও জরিমানার আতঙ্কে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। রমজান মাসে পুরো ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আমরা বলেছি যতদিন সমন্বিত উদ্যোগ না হচ্ছে, ততদিন নির্বিঘেœ ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। আমরা সম্মানের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাই। নিরাপত্তার জন্য এসওপি ঠিক করে দেওয়া হোক।’
এদিকে ‘শাহীন সারোয়ার নামের এক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আমাদের সময়কে বলেন, ভোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সব সংস্থার লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা করতে চাই। রেস্তোরাঁ করতে যতগুলো সংস্থার সনদ লাগে, সবগুলো এক জায়গা থেকে সমন্বিতভাবে দেওয়া হোক। আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস চাই। এভাবে হয়রানি করার কোনো মানেই হয় না। আমরাও এ দেশের নাগরিক। আমরা ব্যবসা করে কোনো অপরাধ করিনি। যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে, সেটা চিহ্নিত করা হোক। যেগুলো সংস্কার করার সম্ভব, সেগুলোর জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিলে আমরা সেগুলো সংশোধন করতে পারব। এভাবে হয়রানি করে ব্যবসা বন্ধ করা যৌক্তিক নয়।’
জাতীয় নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য ও স্থপতি ইকবাল হাবিব আমাদের সময়কে বলেন, আলাদাভাবে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত মূলত জাতীয় নগর উন্নয়ন কমিটির। আমরা এটিকে সাধুবাদ জানাই। তবে জাতীয় নগর উন্নয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত হচ্ছে অভিযানের আগে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি (এসওপি) ঠিক করা। এখন যে অভিযান চলছে, সেটা হচ্ছে অতিঝুঁকিপূর্ণ যেগুলো মনে হবে, সেগুলো আপাতত বন্ধ করে দেওয়া। দেখা হচ্ছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে কিনা। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা। এগুলো যাচাই করা হচ্ছে।
হাইকোর্টের রুল জারি : অন্যদিকে, রাজধানীর হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে আইন অনুযায়ী অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অভিযানের নামে হয়রানি করা কেন অবৈধ নয়- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। মামলার বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এর আগে গত সোমবার রাজধানীর হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে হয়রানিমূলক অভিযান বন্ধ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন হোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিকরা। তারা সব শর্তপূরণে সময় চেয়ে আবেদন করেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ৪৬ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় পুলিশ, রাজউক ও সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করে রিটটি দায়ের করা হয়।