এবার পারিবারিকভাবে ভাঙল জাতীয় পার্টি

রওশনপন্থিদের চিঠিতে ইসির ‘না’

মুহম্মদ আকবর
১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
এবার পারিবারিকভাবে ভাঙল জাতীয় পার্টি

জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান এবং কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব করে দলটির একাংশের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে এরশাদের ছেলে আল মাহগির শাদ এরশাদকে দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে। তবে এ কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে এরশাদের ভাই জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্ন বলেছেন, আরেকটি ‘ব্র্যাকেটবন্দি দল’ হতে পারে; কিন্তু তাদের অংশই মূল জাতীয় পার্টি। এর মধ্য দিয়ে আবারও বিভক্ত হলো জাতীয় পার্টি। দেবর জিএম কাদের ও ভাবি রওশন এরশাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিভক্তির ফলে এবার পারিবারিকভাবেও ভেঙে গেল জাতীয় পার্টি।

গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ প্রাঙ্গণে জাতীয় পার্টির নামে এই ত্রিবার্ষিক সম্মেলন করেন রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা। এতে নতুন নেতৃত্বের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের ১৪ মাস পার হওয়ার পরও নতুন সম্মেলন না দেওয়ায় জিএম কাদেরের নেতৃত্বের বিপরীতে গিয়ে এ সম্মেলন করলেন তারা। এই সম্মেলনকে দলের ধারাবাহিক সম্মেলন তথা দ্বাদশ সম্মেলন হিসেবে অভিহিত করেন তারা।

গতকালের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন পর্যায়ক্রমে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও কাজী ফিরোজ রশীদ। এরপর কাউন্সিল অধিবেশনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের নাম ঘোষণা করা হলে উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা দুহাত তুলে সমর্থন জানান। এরপর প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর দলের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের নাম ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ফিরোজ রশীদকে নির্বাহী চেয়ারম্যান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা সিনিয়র কো- চেয়ারম্যান এবং সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, আল মাহগির শাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার মিলন ও সুনীল শুভ রায়কে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই নাম ঘোষণার পর উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের কাছে মহাসচিব হিসেবে কাজী মামুনুর রশীদের নাম ঘোষণা করেন গোলাম সারোয়ার মিলন। এতে উপস্থিত সবাই তা সমর্থন করেন।

সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এমএ মতিন, বিএলডিপির চেয়ারম্যান এম নাজিম উদ্দীন আল আজাদ, চীনের সহকারী রাষ্ট্রদূত ফেং জিজিয়া প্রমুখ।

সম্মেলন আয়োজন : গত ৭ মার্চ জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক করে আগামী ১২ অক্টোবর সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করে। সেদিন জিএম কাদের রওশনপন্থিদের সম্মেলনে অংশ না নিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশও দেন। তবে জিএম কাদেরের এই নির্দেশ সত্ত্বেও গতকাল রওশনপন্থিদের সম্মেলনস্থল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সম্মেলনে নবনির্বাচিত কো-চেয়ারম্যান সুনীল শুভ রায়ের ভাষ্য, অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে বিপুল মানুষের সমাগম হয়েছে এ সম্মেলনে।

জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে গতকাল দুপুর ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা। এতে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন রওশন এরশাদ অনুসারী জাতীয় পার্টির মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম সারোয়ার মিলন, সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ক্বারী হাবিবুল্লাহ বেলালী, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, শাদ এরশাদ, নুরুল ইসলাম নুরু, রফিকুল হক হাফিজ, এমএ গোফরান, ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরী, শেখ আলমগীর হোসেন, নুরুল ইসলাম নুরু, নিগার সুলতানা রানী, এমএ কুদ্দুস খান, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, শফিকুল ইসলাম শফিক, আমানত হোসেন, ফখরুল আহসান শাহজাদা, হাজী তুহিনুর রহমান নূরু হাজী, মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক, হাজী নাসিরসহ জাতীয় পার্টির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও সারাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক কাউন্সিলর ও ডেলিগেট উপস্থিত হন।

সম্মেলনে রওশন এরশাদ বলেন, ‘আজকে সম্মেলন না হলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেত। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার প্রতিফলন ঘটেছে।’ এই আয়োজন দেখে তার হৃদয় কানায় কানায় ভরে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আাবেদন নাকচ করল ইসি : এর আগে গত সোমবার দলের পদ পরিবর্তন নিয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেন রওশনপন্থিরা। তবে এই চিঠিকে আমলে নেয়নি ইসি। গতকাল শনিবার ইসির উপসচিব মো. মাহবুবুল আলম শাহ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। রওশনপন্থিদের চিঠিতে বলা হয়েছিল, বেগম রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জরুরি বর্ধিতসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে তাদের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সপ্তমবারের মতো ভাঙন : এই নিয়ে দলটি সপ্তমবারের মতো বিভক্ত হলো। এর আগে পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি ভেঙে ছয়টি দলের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। এগুলো হচ্ছে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি), আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ডা. মতিনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (বিজেপি), মোস্তফা জামান হায়দারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও সর্বশেষ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (পুনর্গঠন)। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের), জেপি (মঞ্জু), বিজেপি (পার্থ), জাতীয় পার্টি (ডা. মতিন) এই চার দলের নিবন্ধন রয়েছে।

মুজিবুল হক চুন্নুর প্রতিক্রিয়া : এই সম্মেলনে নতুন নেতৃত্বের নাম ঘোষণার পর জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, ‘রওশন এরশাদপন্থিদের পৃথক সম্মেলন করার বিষয়টি দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী। তিনি বলেন, ‘আরেকটি ব্রাকেটবন্দি দল হতে পারে। কিন্তু জিএম কাদেরের নেতৃত্বে আমরাই মূল জাতীয় পার্টি।’ তিনি বলেন, তারা অন্য অংশের তৎপরতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।