সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা দৃষ্টি নেই গবেষণায়

মোবাইলের ছবি দিয়ে চাঁদাবাজি

এম এইচ রবিন
০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা দৃষ্টি নেই গবেষণায়

শিক্ষাদান, গবেষণা, গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পের সঙ্গে জ্ঞানের বিনিময় এসব সূচকে পিছিয়ে থাকার কারণে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরাদের তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ^বিদ্যালয়। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণাবিমুখ; চলে মুখস্থনির্ভর তথা সার্টিফিকেটসর্বস্ব পড়ালেখা। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন দৈন্যদশা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি বা বেসরকারি যেটিই হোক, দেশের সেরা বিশ^বিদ্যালয় কোনটি? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই দুরূহ। বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শীর্ষে থাকে, তাদের সফলতার নেপথ্যে রয়েছে গবেষণা নির্ভরতা। গবেষণার সঙ্গে আরও পাঁচটি সূচকের মানদণ্ডে নির্ধারিত হয় সেরা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণে ‘রূপকল্প ২০২১-২০৪১’ বাস্তবায়নে সরকার ২০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার পর অর্থাৎ ২০৪১ সালের পর আমাদের কোন বিশ^বিদ্যালয়টি বৈশি^ক মাপকাঠিতে হবে বিশে^, অন্ততপক্ষে এশিয়ার সেরা পঞ্চাশ-একশোর মধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সেটি এখনো দৃশ্যমান হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্তত ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোনো কানাকড়ি ব্যয় করেনি।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুক গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ববিদ্যালযয়ের মূল একাডেমিক লেখাপড়ার সঙ্গে গবেষণাও আবশ্যক। যেসব বিশ^বিদ্যালয় গবেষণায় মনোযোগী হবে না, সেগুলো এক সময় প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে। আমরা (ইউজিসি) বলেছি যে,বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের অন্তত দুই শতাংশ অর্থ গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।

আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা চলছে উল্লেখ করে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, সার্টিফিকেট নির্ভরতার কারণে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং তো দূরের কথা, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের সেরাও বলা যায় না। তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। আর কত বছর আমাদের শুনতে হবে, বাংলাদেশের বিশ^বিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা পঞ্চাশ তো দূরের কথা, একশটির মধ্যেও নেই?

এ শিক্ষাবিদ বলেন, র‌্যাঙ্কিংয়ে আসতে হলে, প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত মোটা দাগে এসব সূচকই দেখা হয়। গড়পড়তায় লেখাপড়ার পাশাপাশি এসব দিকেও আমাদের বেশি নজর দেওয়া উচিত।

জানা গেছে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশনের (টিএইচই) গবেষণার সূচক হচ্ছে- শিক্ষাদান (টিচিং), গবেষণা (রিসার্চ), গবেষণা-উদ্ধৃতি (সাইটেশন), আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি (ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক) এবং ইন্ডাস্ট্রিজ ইনকাম (শিল্পের সঙ্গে জ্ঞানের বিনিময়)।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব রয়েছে, রয়েছে জাতীয় বাজেটের স্বল্পতা। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি; প্রাতিষ্ঠানিক ও দায়িত্বশীলদের দুর্নীতি অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সততা ও মূল্যবোধের অভাব আছে। অভাব আছে প্রাতিষ্ঠানিক সুনামেরও। পাঠকক্ষে শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি। দক্ষতার ঘাটতিতে চাকরির বাজারে সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নের জন্য রাজনীতির প্রভাবও কম নয়। কোথাও আবার শিক্ষার চেয়ে রাজনীতি চর্চায় বেশ মনোযোগী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গড়পড়তায় এসব কারণেই উচ্চশিক্ষার দৈন্যদশা।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক তাহমিনা খানম বলেন, আমাদের দেশে যে পরিমাণ গবেষণা খাতে ব্যয় হয়, এর সঠিক তথ্য-উপাত্য অনেক বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, আমাদের গবেষণার বদলে চলে মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা, চলে চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখা। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্ত জ্ঞানচর্চার স্থান। শিক্ষার্থীরা গবেষণা করবেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন করবেন। কিন্তু হচ্ছে ঠিক উল্টোটা। শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হচ্ছে কিছু পাঠ্যবই, লেকচার শিট, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা আর নামমাত্র রিসার্চ পেপার। এসবের যথার্থতা শিক্ষকরা ঠিকভাবে বিচার করেও দেখেন না। তাদের মুক্ত জ্ঞানচর্চার সুযোগ না দিয়ে বরং ক্লাসে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা হয়।

প্রসঙ্গত, বিশ্বের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে মূলত গবেষণানির্ভর বিশ^বিদ্যালয়। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড, যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের বাজেটের বেশির ভাগই ব্যয় করা হয় গবেষণায়।