আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সিজার
স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করা একজন নারীর অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভিন্নচিত্র দেখা যায়। স্বাভাবিক সন্তান প্রসব দেওয়ার বিপরীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সি-সেকশন নামে পরিচিত সিজারের (অস্ত্রোপচার) মাধ্যমে সন্তান জন্মদান। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, স্বাভাবিক প্রসবের (ডেলিভারী) আলাদা রুম ও সরঞ্জামাদির ঘাটতিসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বেশি মুনাফার লোভ অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা। তারা বলছেন, সন্তান প্রসবে সিজারের হার এভাবে বাড়লে দীর্ঘমেয়াদে বড় হুমকির মুখে পড়বে মা ও শিশু স্বাস্থ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সি-সেকশন বা সিজারে সন্তান প্রসব গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি ৫টির মধ্যে ৩টি শিশুর জন্ম (৫৮.২১%) হয়েছে সিজারে। এ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলেও এ হার কম নয়।
এ ছাড়া উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে সিজারে সন্তান প্রসব করার প্রবণতা বেশি।
জরিপে উঠে এসেছে, খুলনা বিভাগ সিজারে সন্তান প্রসব করার হার সবচেয়ে বেশি। আর সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক ডেলিভারি হয় সিলেট বিভাগে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৮৪ দশমিক ৮৬ শতাংশই সিজারে প্রসব হয়।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বাভাবিক জন্ম হলো সবচেয়ে আদর্শ এবং সবচেয়ে বেশি উপযোগী জন্ম পদ্ধতি। যখন স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না অথবা প্রসূতি বা নবজাতকের স্বাস্থ্য বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, কেবল তখনই সি-সেকশন পদ্ধতির সুপারিশ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে- বেশির ভাগ প্রসব সম্পন্ন হচ্ছে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। প্রসূতিদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা স্বাভাবিকের বদলে সিজারকে প্রাধান্য দেন।
স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করতে চেয়েছিলেন ঢাকার মাতুয়াইল এলাকার প্রসূতি মা নূপুর আক্তার। তিনি বলেন, যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছি, তারা সিজারের জন্য বলেছে। শেষ পর্যন্ত অনেক আগভাগেই সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে হয়েছে। এর ফলে আমার ও বাচ্চার নিয়মিত নানা ধরনের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিবিএস পরিচালিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিক্্স-২০২২’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ২০২২ সালে সি-সেকশনের মাধ্যমে প্রতি পাঁচটির মধ্যে দুটির বেশি (৪১.৩৭%) জন্ম হয়েছে। পল্লী এলাকার তুলনায় সিটি করপোরেশন এলাকায় সি-সেকশনের প্রবণতা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি পাঁচটির মধ্যে তিনটি জন্ম (৫৮.২১%) হয়েছে সি-সেকশনের মাধ্যমে। যেখানে পৌরসভা ও অন্যান্য শহরাঞ্চলে এ হার ৫১ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন হার পল্লী এলাকায় (৩৮.৪৬%)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রসূতির শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সি-সেকশন করার মধ্যে নেতিবাচক সম্পর্ক লক্ষ করা গেছে। কেননা উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতাধারী প্রসূতিদের সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। সম্পদের কুইন্টাইল হিসাবের সঙ্গে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্র একই ধরনের।
আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. আনজুমান আরা রিতা আমাদের সময়কে বলেন, সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করলে প্রসূতি মা ও সন্তানের ক্ষতি হয়। প্রতিটি রোগীকে আমরা স্বাভাবিক প্রসবের সুবিধা বুঝিয়ে বলি। সিজারে বড় ধরনের যে জটিলতা স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে সে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে রোগী ও চিকিৎসকের ধৈর্যের অভাবে তারা সিজার করে।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবদানের রুম ও সরঞ্জামাদি থাকে না। এ ছাড়া স্বাভাবিক সন্তান প্রসবদানে প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। স্বাভাবিক প্রসব নারীর অধিকার। এ জন্য পরিবার ও চিকিৎসকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন