জ্বালানির দাম নামমাত্র কমল

৪৬-৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল, কমানো হলো ০.৬৯-৩.০৭ শতাংশ

লুৎফর রহমান কাকন
০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
জ্বালানির দাম নামমাত্র কমল


জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে নতুন ফর্মুলা জারি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো এর দাম কমিয়েছে সরকার। সব ধরনের জ্বালানি তেলেই অল্প পরিমাণে দাম কমানো হয়েছে। এতে বাজারে আদৌ কোনো প্রভাব পড়বে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ ডিজেল ও কেরোসিনে ০.৬৯ শতাংশ, অকটেনে ৩.০৭ শতাংশ এবং পেট্রলে ২.৪ শতাংশ দাম কমানো হয়েছে। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। ফলে মাত্র ০.৬৯ শতাংশ দাম কমার প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে খুব বেশি পড়বে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জ্বালানি বিভাগ। আজ শুক্রবার থেকে নতুন দর কার্যকর হবে।

প্রসঙ্গত, লোকসানের যুক্তিতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৮০ থেকে ৩৪ বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়। লিটারপ্রতি পেট্রলের দাম ৮৬ থেকে ৪৪ বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়। অকটেনের দাম ৮৯ থেকে ৪৬ বাড়িয়ে করা হয় ১৩৫ টাকা। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট এই চার ধরনের জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা করে কমানো হয়।

অর্থাৎ ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে মাত্র ৩-৪ শতাংশ কমানো হয়েছিল। এবার ০.৭ থেকে ৩ শতাংশ দাম কমানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে সরকার গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির ঘোষণা করে। এ পদ্ধতি অনুসারে দেশে প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হলো।

প্রজ্ঞাপন অনুসারে, প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের বর্তমান বিক্রয়মূল্য ১০৯ থেকে ৭৫ পয়সা কমিয়ে ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা করা হয়েছে। প্রতি লিটার অকটেনের দাম ১৩০ থেকে ৪ কমিয়ে ১২৬ টাকা এবং পেট্রল ১২৫ থেকে ৩ কমিয়ে ১২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারের দাম অনুসারে দেশে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমা উচিত ছিল। সরকার নামমাত্র দাম কমিয়েছে। তারা আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমার প্রভাব পরিবহনের ভাড়ার ওপর না পড়লে জনগণ দাম কমার সুফল পাবে না।

জ্বালানি বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, এখন থেকে প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের আমদানিমূল্য অনুসারে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য সমন্বয় করা হবে। এতে আরও বলা হয়, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় বর্তমানে ডিজেল লিটারপ্রতি ১৩৩ টাকা ৫৭ পয়সা (১ রুপি = ১.৪৪ টাকা) এবং পেট্রল ১৫২ টাকা ৬৮ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে, যা বাংলাদেশ থেকে যথাক্রমে প্রায় ২৪ টাকা ৫৭ পয়সা এবং ২৭ টাকা ৬৮ পয়সা বেশি।

বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, জ্বালানি তেলের নতুন মূল্য নির্ধারণের ফর্মুলা অনুসারে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মিল রেখে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকায় দেশে দাম কমেছে। দাম কমার সুফল জনগণ পাবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে আজাদ বলেন, অবশ্যই সুফল মেলা উচিত। কিন্তু এটা বিপিসির হাতে নেই।

নামমাত্র দাম কমেছে

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, সরকার নামমাত্র দাম কমিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান তেলের যা দাম, সে অনুসারে দাম আরও কমা উচিত ছিল। দাম কমানোর ক্ষেত্রে সরকার কি পদ্ধতিতে হিসাব করেছে- তা স্পষ্ট নয়। বিপিসির আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তেলের দাম কমেছে কিন্তু পরিবহন ভাড়া না কমলে এর সুফল তো জনগণ পাবে না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমেছে এটা স্বস্তির বিষয়। তবে যতটুকু দাম কমেছে তা খুবই সামান্য। এর আগে (২০২২ সালে) তেলের দাম বাড়িয়ে কৃষি, পরিবহন ও অন্যান্য খাতে বড় ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এবার দাম এত অল্প কমানো হয়েছে যে, খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, গতবার ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষকের বিঘাপ্রতি ব্যয় বেড়েছিল ২০০০ টাকা। তার মতে, দাম কমাটা স্রেফ একটা মানসিক স্বস্তি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, দাম কমানোর প্রক্রিয়াটি আরও ভোক্তাবান্ধব হওয়া উচিত। বর্তমানে বিশ্ববাজারে যা দাম তাতে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম হওয়া উচিত ১০০ টাকার মতো। তিনি পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর প্রত্যাহারেরও দাবি জানান।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, দাম কমানোর লাভ মূলত পাবে ধনী ব্যক্তিরা। ডিজেলের সামান্য দাম কমায় পরিবহন ভাড়া কমবে না, মূলত পরিবহন ব্যবসায়ীরা লাভ করবে।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ডিজেলের দাম ৭৫ পয়সা কমার কোনো প্রভাব পরিবহন ভাড়ার ওপর পড়বে না।

লাভ করে বিপিসি

বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকায় লাভ করছে বিপিসি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিসি নিট মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা। এ সময় সরকারি কোষাগারে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে বিপিসির কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি।

এর আগে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত কর-পরবর্তী বিপিসির নিট মুনাফা হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। ওই সময়ে সরকারকে লাভ দিয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিপিসির উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে দুই দফায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। আর জ্বালানি তেলের শুল্ক-কর থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। টানা সাত বছর মুনাফা করার পর ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে সংস্থাটি। তখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) ১৪০ ডলার আর ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে দাম কমতে থাকে।

বৃহস্পতিবার বিশ্ববাজারে মারবান ক্রডের (অপরিশোধিত) দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৩.০৪ ডলার। ডিজেলের দাম বর্তমানে প্রতি ব্যারল ৯৫ ডলার।

দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় এক কোটি টন। এর মধ্যে বিপিসি ৬৫-৭০ লাখ টন আমদানি করে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ২০-২৫ লাখ টন আমদানি করে। আর দেশের পরিশোধনাগার থেকে কিছু তেল পাওয়া যায়।

এদিকে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সবসময় অস্থিতিশীল। এখন কিছুটা কম হলেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ডলারের রেট ৮০ থেকে ১২০-১৩০ টাকা পর্যন্ত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এজন্যই আমরা একটা ফরমুলা করে দিয়েছি। সেই ফর্মুলা অনুযায়ী প্রতি মাসে সমন্বয় হবে। মানুষ সুফল পাবে।

ব?াংলা?দেশ সড়ক প?রিবহন কর্তৃপ?ক্ষের (বিআর?টিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, জ্বালানির দাম সমন্বয়ের প্রজ্ঞাপন দে?ঞাপন দেখেছি। গণপরিবহনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি পর্যালোচনা করবে। এরপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।