অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে সমস্যার মূলে যেতে হবে

আবুল মোমেন
০৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে সমস্যার মূলে যেতে হবে

যে কোনো মানুষের জীবনই অমূল্য। কিন্তু বাংলাদেশে যেন সেই জীবনই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরী। রাজধানীবাসী এ কারণে ফুসফুসসহ শারীরিক নানান রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে এখন অগ্নিকাণ্ড আরেক বিভীষিকা হয়ে দেখা দিয়েছে রাজধানীতে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০১০ সালে ঢাকার নিমতলীতে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। সর্বশেষ বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে অন্তত ৯টি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণ ও আগুনে ৭১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। ২০২৩ সালের বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের অগ্নিকা-ে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এভাবে প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপকভাবে। প্রতিবারই অগ্নিকা-ের কারণ, প্রত্যক্ষ দোষী ও তদারকিতে গাফিলতির জন্য দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থাও শনাক্ত হয়। কিন্তু কাজ হয় ওই পর্যন্ত।

সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পরস্পরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত রাখার চেষ্টা চালায়। গণমাধ্যম বিভিন্ন মানবিক স্টোরি ছাপিয়ে ও প্রচার করে জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে পারলেও তাতে সমাধানের কাজ বেশি দূর এগোয় না।

বর্তমান সরকারের সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন তার সময়ে রাজধানীর ১ হাজার ৩০০ ভবনকে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত দেশের ভবনগুলো সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়। গত বছর তারা সারাদেশে ৫ হাজারের অধিক ভবনের মধ্যে ২ হাজারের বেশি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছিল। দেখা যাচ্ছে বেইলি রোডের সংশ্লিষ্ট ভবনটিকেও তিন দফা অগ্নিঝুঁকির জন্য সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। রাজউক থেকে ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তর পৃথকভাবে কাজ করে কোনো সুফল আনতে পারছে না। দিনে দিনে জনজীবন হয়ে পড়েছে অনিরাপদ, পদে পদে মৃত্যুঝুঁকি তাদের ওপর হানা দিচ্ছে। এসব মৃত্যু এড়ানো যেত, তাই পরিবার এবং দেশবাসীর এত আফসোস এবং ক্ষোভ।

আমরা মনে করি যথেষ্ট হয়েছে, এবার কাজের কাজ করতে হবে। প্রথম দায় হলো সরকারের, কেন তারা সমস্ত রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রশাসনিক নির্দেশনাকে রাজধানীকেন্দ্রিক করে ঢাকার ওপর চাপ বাড়াচ্ছেন। সারাদেশে বহু ঐতিহ্যবাহী শহর ছড়িয়ে থাকলেও একের পর এক সরকার নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত করার নীতি গ্রহণ করার ফলে বাংলাদেশ আজ এক-নগরীর দেশে পরিণত হয়েছে।

দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে, প্রথম কারণটির ধারাবাহিকতায় ঢাকায় অব্যাহতভাবে মফস্বল থেকে অভিবাসন ঘটে চলেছে। তারা প্রত্যেকেই মাথা গোঁজার ঠাঁই চান। এ কাজে ধরাধরি, সুপারিশ, দুর্নীতি সবই চলে। মরিয়া-হয়ে-ওঠা মানুষ এভাবেই পরস্পরের অন্যায় সহযোগিতায় টিকে থাকে। ফলে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, সম্প্রসারণ, ব্যবহার কিছুই ঠেকানো যাচ্ছে না।

তৃতীয়ত দুর্নীতি ও অব্যবস্থায় অনেকের সুবিধা হয় তাই তারা, ভোক্তা ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিগণ, পারস্পরিক সুবিধা বিনিময় করে সহাবস্থান করেন। এতে যুগপৎ দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতি বহাল থাকে, সবার গা-ছাড়াভাবের কারণে এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।

এ অবস্থায় আমরা বলব, বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তা বাস্তবায়ন করাও সহজ। সমস্যার উৎস বন্ধ না করে নানা শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থার হুমকি দিলেও বা দু-একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলেও দীর্ঘমেয়াদে ফল পাওয়া যাবে না। বরং ঢাকা ও দেশের অন্যান্য জেলাতেও অগ্নিদুর্ঘটনাসহ নানা দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি, সম্পদহানি এবং স্বাস্থ্যহানি ইত্যাদি বাড়তে থাকবে। ফলে আমরা বলব, প্রথমে বিকেন্দ্রীকরণের কথা ভাবতে হবে, তারপরে জেলা শহরগুলোর সঙ্গে রাজধানীর দ্রুত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে এবং সব জেলা শহরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের আধুনিক উন্নত সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এভাবে হয়তো এক সময় আমরা নাগরিকদের স্বস্তির জীবন উপহার দিতে সক্ষম হব।