প্রাণহীন একা দাঁড়িয়ে গ্রিন কোজি কটেজ
দেখা থেকে লেখা
বেইলি রোডের প্রবেশ সড়ক থেকে ততক্ষণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে পুলিশের ব্যারিকেড। যান চলাচল এবং জনজীবন অনেকটাই স্বাভাবিক। সড়কের দুপাশ দিয়ে ছুটছেন ব্যস্ত রাজধানীবাসী। দেখে বোঝার উপায় নেই একদিন আগেই সেখানে ঘটে গেছে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা। গতকাল শনিবার দুপুরের কথা। কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল উৎসুক মানুষের জটলা। সবার চোখ সড়কের ওপারে। সামনেই ভূতুড়ে অবয়ব নিয়ে একা দাঁড়িয়ে বৃহস্পতিবার রাতের আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ। পোড়া ভবন দেখে বারবার আঁতকে উঠছেন তারা। মুখে মুখে ফিরছে সেদিনের নানা গল্প। অধিকাংশই হৃদয়বিদারক। ভবনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে ক্ষোভ প্রকাশও করছেন কেউ কেউ।
প্রবেশ সড়ক থেকে ব্যারিকেড তোলা হলেও ভস্মীভূত ভবনটি তখনও হলুদ ব্যারিকেডে ঘেরা। নিরাপত্তায় ভবন ঘিরে দাঁড়িয়ে পুলিশ সদস্যরা। বাতাসের সাথে মিশে হঠাৎ হঠাৎ পোড়া গন্ধ এসে লাগছে নাকে। ভবনের সামনেই পড়ে আছে ভাঙা কাচের টুকরো, আর ভবনে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত আসবাবপত্রের টুকিটাকি। পুড়ে ছারখার হয়ে পড়ে আছে আগুন নেভাতে ব্যবহার হওয়া কয়েকটি ফায়ার এক্সটিনগুইসার। বৃহস্পতিবার রাতের আগুনে পুড়ে গেছে ভবনের সাথে লাগোয়া ছোট্ট একটি বাগান বিলাস গাছও। বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেলেও বেশ কয়েকটি রঙিন পাতা তখনও মৃত্যু উপত্যকায় যেন জীবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে। মুঠোফোনে ভবনটির ছবি তুলতে দেখা যায় সামনের সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী ও পথচারীদের।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজধানীর বিজয়নগর এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন। তিনি জানান, বিভিন্ন কাজে প্রায়ই তিনি এই ভবনে আসতেন। তবে রেস্তোরাঁয় বসে কখনো খেতেন না। ভবনটি পুড়ে যাওয়া এবং ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর শুনে দেখতে এসেছেন। এ সময় ভবনের অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
ভাগ্যকে ধন্যবাদ!
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ভবনের সামনে ভিড় জমানোদের মধ্যে অনেকেই গ্রিন কোজি কটেজে আগে এক বা একাধিকবার এসেছেন, সময় কাটিয়েছেন বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবারের সাথে। তেমনই একজন মগবাজার এলাকার বাসিন্দা সাকিব। ভবনের পাঁচতলার একটি রেস্টুরেন্টে বসা নিজের ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘দশ-পনেরো দিন আগেই এই রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছিলাম। অনেকক্ষণ ছিলাম সেখানে। মূলত নিচের একটি পোস্টার দেখেই খেতে এসেছিলাম। ঘটনা ওইদিন ঘটলে তো আমিও বেঁচে থাকতাম না।’ সাকিবের মতো ওই ভবনে আগেও যারা এক বা একাধিকবার এসেছেন, তারা ধন্যবাদ জানাচ্ছেন নিজেদের ভাগ্যকে গত বৃহস্পতিবার রাতে আসেননি বলে।
বিপদের বন্ধু নাটক সরণির পুষ্করিণী
ঘটনার রাতের ঘটনা জানাচ্ছিলেন গ্রিন কোজি কটেজের পাশের ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, আগুন হঠাৎই ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আমাদের বিল্ডিংয়ের লোকরাও তখন নিচে নেমে আসে। প্রথমে স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। অল্প সময়ের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিস চলে আসে। তবে (সামনের ভবন দেখিয়ে) ওইটার পেছনে একটা পুকুর আছে ওইখান থেকে পানি আনতে না পারলে আরও সময় লেগে যেত।’ ২৫ নম্বর নাটক সরণিতে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায় বেশ বড় জায়গা নিয়ে একটি পুকুর। জল কালো হয়ে এলেও গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগার পর এটিই ছিল বিপদের বন্ধু।
জাগতে শুরু করেছে বেইলি রোড
দুর্ঘটনার পরদিনও বন্ধ ছিল না ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের আশপাশের নামিদামি রেস্তোরাঁগুলো। গতকাল বিকালেও রেস্তোরাঁগুলোতে খেতে দেখা যায় অনেককে। যদিও রেস্তোরাঁসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্ঘটনার পর খেতে আসা মানুষের সংখ্যা কমেছে। এ সময় বেশ কয়েকজনকে পার্সেল নিয়েও চলে যেতে দেখা যায়। বেইলি রোডের একটি নামি রেস্তোরাঁর কর্মী বলেন, ঘটনার পর মানুষের চাপ এখন কম। গতকালও তেমন একটা মানুষ আসেনি। আজও বিকাল পর্যন্ত খেতে আসা মানুষের সংখ্যা কম। তবে সন্ধ্যা থেকে হয়তো বাড়তে পারে।
রেস্তোরাঁ ছাড়াও বেইলি রোডের ওই সড়কে চালু রয়েছে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেসব প্রতিষ্ঠানে চোখে পড়ে ক্রেতাদের উপস্থিতিও। সব মিলিয়ে প্রাণোচ্ছল বেইলি রোডে একমাত্র প্রাণহীন গ্রিন কোজি কটেজ; যার পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনার ভয়াবহতার সাক্ষী দিচ্ছে আধপোড়া আমগাছ।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন