গ্রীষ্মে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ
প্রতি বছরের মতো এবারও গ্রীষ্মে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে চ্যালেঞ্জ্যের মধ্যে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে চিন্তিত বিদ্যুৎ বিভাগ। খোদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে দৈনিক আমাদের সময়কে বলেছেন, সংকট এড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার। এমন বাস্তবতায় বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সরবরাহে কোনো সংকট দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত লোডম্যানেজম্যান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
জানা গেছে, সরকারি হিসাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াটের বেশি। সারা বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ থাকে গড়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় কোনো সমস্যা নেই, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি সরবরাহই বড় চ্যালেঞ্চ।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আসন্ন রমজান মাস, গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে আনুমানিক বিদ্যুৎ মাসিক চাহিদা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ২০২৩ সালের বিবেচনায় চাহিদা বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশের মতো। তবে এ বছর কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়েছে। তবে শঙ্কার জায়গা হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, মোট ২৬ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা হলো ৫ হাজার ৯৮৭ মেগাওয়াট, যা মোট সক্ষমতার ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার ৬৮৬ মেগাওয়াট, যা মোট সক্ষমতার ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার ৪৯২ মেগাওয়াট, যা মোট সক্ষমতার ২৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনে মূলত কয়লা, গ্যাস এবং ফার্নেস অয়েলভিত্তিক জ্বালানিই প্রধান ভরসা। তবে কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেল তিনটিই আমদানিনির্ভর। প্রয়োজনীয় অর্থ সংকট এবং ডলার সংকটে তিনটি জ্বালানি দ্রব্যই আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আমাদের সময়কে বলেন, মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন- এই চার মাস বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তবে বৈশি^ক সংকট এবং ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, বিশেষ করে কয়লা ও গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। সে চেষ্টা মন্ত্রণালয় করে যাচ্ছে। কোনো কারণে কয়লার সরবরাহের চেইন ঠিক রাখতে না পারলে সংকট তৈরি হতে পারে। ফলে সব কোম্পানি ও সংস্থাকে বলে দেওয়া হয়েছে সতর্ক থাকতে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, এখন পিক-অফপিক প্রায় একই হয়ে গেছে। আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কারণে সকাল-সন্ধ্যা বা রাতে প্রায় সময় আবহাওয়া গরম থাকে। ফলে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় একই থাকে। তিনি বলেন, ডলার রেট বেড়ে যাওয়ার কারণে কয়লা, এলএনজি আমদানিতে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থ সংকটের কারণে যেখানে আগে বছরে ৯০টি কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল, সেখানে ৪৬টি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালীন সময়ে বিদ্যুতের অপচায়রোধ করতে হবে। মানুষকে সচেতন হতে হবে। মানুষ প্রয়োজন ছাড়াও ঘরের এসি, ফ্যান বা বিদ্যুতের ব্যবহার করে থাকেÑ এগুলো থেকে সরে আসতে হবে। গ্রাহকরা সচেতন থাকলে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
এদিকে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন বা সরবরাহের যে সোর্স রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আরও আছে ডিজেল ভিত্তিক ৪৯০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাইড্রো বা জলবিদ্যুৎ থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, সোলার থেকে ৪৫৯ মেগাওয়াট। তবে সোলার, ডিজেল বা জলবিদ্যুৎ চাহিদার খুব কম অংশ সরবরাহ করতে পারে। এছাড়াও রয়েছে ভারত থেকে প্রায় ২৬০০ মেগাওয়াট আমদানিকৃত বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও গ্যাসের অভাবে প্রায় উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সারাবছর বন্ধ থাকে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা হয় ৯০০ থেকে ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে সক্ষমতার বড় একটি অংশ বসিয়ে রাখতে হয়। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মিত বন্ধ থাকে প্রায় ২০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর বাইরে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন সংকটের কারণেও প্রায়ই বন্ধ রাখতে হয় অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সর্বশেষ মাতারবাড়ী কোল পাওয়ার কোম্পানি ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে পারছে না গ্রিড সংকটের কারণে।
এদিকে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিতে আলাদা আলাদা খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে কোম্পানিগুলো কোথা কোথাও অল্পস্বল্প লোডশেডিং করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গরমের শুরুতেই লোডশেডিং শুরু করেছে। এছাড়া রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) বিতরণ এলাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামে লোডশেডিং করছে কোম্পানিটি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ খাতের পরামর্শক সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, এ বছর ডলার সংকটের কারণে নতুন একটি সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহে নানা পরিকল্পনা করছে। তিনি বলেন, কোনো কারণে যদি চাহিদার সমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম না হয় কেন্দ্রগুলো, তবে লোডম্যানেজম্যান্টের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। সে বিষয়টি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলো ঠিক করবে।