পুণ্যের মাস এলেই ভোক্তার পকেট কাটতে মরিয়া চক্র
পবিত্র রমজান মাস এলেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর, যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। রোজায় বেশকিছু পণ্যের বাড়তি চাহিদাকে জিম্মি করে অল্প সময়ে অতিরিক্ত টাকা কামাতে মরিয়া হয়ে উঠছে অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্র। কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, রমজান শুরুর অনেক আগেই নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এবারও রোজার মাস দু-এক আগে থেকেই অসাধু ব্যবসায়ীদের ‘রোজার কারবার’ শুরু হয়ে গেছে। এমনকি যেসব পণ্যের দাম কমে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে, সেগুলোর দামও ফের বাড়ানো হয়েছে। উচ্চমূল্যস্ফীতির এ বাজারে পকেট কাটা দামের কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ সংসার
খরচ সামাল দেবেন কীভাবে, এ নিয়ে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় আছেন।
অনেক দিন পর মাংসের বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও আসন্ন রোজা সামনে রেখে আবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এর আগে গরুর মাংসের কেজি সর্বোচ্চ ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় পৌঁছলে নিম্নবিত্তদের পাশাপাশি অনেক মধ্যবিত্তও এ পণ্যটি কেনা থেকে বিরত ছিলেন। মাঝে কয়েক ব্যবসায়ীর ইতিবাচক উদ্যোগে কেজি ৫৯০ টাকায় বিক্রি শুরু হয়। একপর্যায়ে অন্যান্য ব্যবসায়ীও দাম কমাতে বাধ্য হন, নতুন দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৫০ টাকা কেজি। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রের দাপটে এ দাম বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নির্ধারিত দাম বাতিল করে দাম বাড়িয়ে ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা করা হয়। সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, রোজা শুরু হতে এখনো অন্তত ১৫ দিন বাকি। এর মধ্যেই দাম আরেক দফা বেড়েছে। এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা দরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাংসের বাজারে সিন্ডিকেট এতটাই সক্রিয় যে, কম দামে মাংস বিক্রয়কারীদের হত্যার হুমকি পর্যন্তও দেওয়া হয়েছে।
বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করার সুবাদে দেশব্যাপী আলোচিত রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় মাংস বিক্রেতা মো. খলিল বলেন, কম দামে বিক্রি করায় হত্যার হুমকি পেতে হয়েছে আমাকে। থানায় জিডি করার পর তা বন্ধ হয়েছে।
এদিকে হঠাৎ ৬৫০ থেকে দাম বেড়ে ৭৫০ টাকা হওয়ার পেছনে যুক্তি দেখিয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা আমাদের সময়কে বলেন, ৩ মণ ওজনের গরু মাঝে ৮৫ হাজারেও পাওয়া গেছে। এখন তা ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে দাম বাড়িয়ে
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
৭৫০ টাকা করতে হয়েছে। এতেও লোকসান হচ্ছে। অনেকে ৮০০ টাকাও বিক্রি করছে।
ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজারেও একই চিত্র। নানা নাটকীয়তার পর অনেকটা সময় মুরগি ও ডিমের বাজার শান্ত থাকলেও বর্তমানে রোজার ঠিক আগমুহূর্তে লাফিয়ে দাম বাড়ছে। ইতোমধ্যেই কম আয়ের মানুষের আমিষের অন্যতম উৎস ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে। ডিমের হালিও ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে।
হঠাৎ অস্থিরতার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার আমাদের সময়কে বলেন, এ খাতে কিছুই বদলায়নি। আগে যা ছিল তাই আছে। কিচ্ছু বদলায়নি। সামনে রোজা, কিন্তু মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ছে। এর পেছনে বড় কোম্পানিগুলোর একদিনের বাচ্চার বাজার সিন্ডিকেট দায়ী। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে একদিনের বাচ্চার দাম ৫২ টাকা বেঁধে দেওয়া হলেও বর্তমানে প্রতি পিস বাচ্চা ৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এরপর বাচ্চার সংকট তৈরি করে রাখা হয়েছে। বাচ্চার দাম বেড়ে গেলে খামারে দাম তো বাড়বেই। তার ওপর ফিডের বাজারও তাদের কব্জায়।
মুড়িকাটা পেঁয়াজে বাজারে স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এদিকে ভারত সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পরেও আসন্ন রোজায় ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে পেঁয়াজের আমদানির চেষ্টা চালানো হয় এবং ভারত বাংলাদেশসহ ছয় দেশে রপ্তানির সিদ্ধান্তও নেয়। এমন খবরে আশা করা হয়েছিল দাম কমে আসবে। কিন্তু সেখানেও হতাশ হতে হয়েছে ভোক্তাকে। পেঁয়াজের দাম এখনো ২০০ টাকার ওপরেই রয়েছে। খুচরায় ২১০ থেকে ২১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত রপ্তানি করবে এমন খবরে অনেক মজুদদার দাম কমিয়ে ছাড়ছে। তবে এখনো অনেকে রোজার ব্যবসা করতে পেঁয়াজ ধরে রেখেছেন। দাম আশানুরূপ কমছে না।
বাজারচিত্র বলছে, আসন্ন রোজার আগেই চাল-ডাল, পেঁয়াজ, ছোলা, খেজুর থেকে শুরু করে মাংস, ডিম, এমনকি চিড়া-মুড়ির দামও লাফিয়ে বেড়েছে। শুধু আমদানিকৃত পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়েছে। এমনকি অনেক পণ্যের ভালো উৎপাদনের পরেও বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে ভোক্তাকে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে মাসের ব্যবধানে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র। বছরের ব্যবধানে তুলনা করলে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে এবার পেঁয়াজ, চিনি, ছোলা, অ্যাংকর, মসুর, পাম তেল, আলু, মসলা, মাংস ডিমের মতো দরকারি পণ্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধির হার আরও বেশি।
রোজায় প্রতিদিনের ইফতার আয়োজনের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত পণ্য ছোলা। এবার রোজার দুই মাস আগেই পণ্যটির দাম একলাফে ৯০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় পৌঁছায়। সাধারণ মানের ছোলা ১১০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। ইফতারসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত ব্যবহৃত অ্যাংকর ডালের দামও ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। বেড়েছে মুগ ও মোটা দানার মসুর ডালের দামও।
কথা হলে মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানান বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ। তিনি বলেন, বিশ্ববাজার ঠিকঠাকই থাকলেও দেশে ডলার সংকট ও বাড়তি দামের কারণে এলসি খোলা ব্যাহত হয়েছে। আমদানিও কমেছে। এতে ছোলাসহ সব ডালের দাম বাড়তি। তারপরও রোজার জন্য বর্তমানে নতুন ছোলার আমদানি আসায় সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু যেগুলো এসেছে তার সিংহভাগই নিম্নমানের। ভালো মানের সংকট থাকায় দাম বাড়তি।
রোজার আরেকটি পণ্য খেজুরেও একই চিত্র। ডলার সংকট ও বাড়তি দামের অজুহাতে সব ধরনের খেজুরের দাম লাফিয়ে বেড়েছে। খোদ ব্যবসায়ীরাই জানিয়েছেন, গত বছরের চেয়ে দাম এবার বেশি বেড়েছে।
রাজধানীর বাদামতলীর হালিমা ট্রেডার্সের মো. কাননসহ একাধিক খেজুরের আমদানিকারক জানান, ডলার সংকটের কারণে এবার ছোট আমদানিকারকরা ব্যাংকে বারবার গিয়েও ফিরে এসেছে। এবার বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি বেশি করতে পেরেছে। ছোটরা বড়দের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিক্রি করছে। এতে এক হাত বেশি বদল হওয়ায় দাম অনেক বাড়তি এবার।
নৈতিক ব্যবসার বদলে ব্যবসায়ীদের লোভ দিনদিন বাড়ছে। অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা করতে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, রোজায় বিক্রি কয়েকগুণ বাড়লে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যবসায়ীরা দাম কমান। অথচ আমাদের এখানে উল্টো যে যেভাবে পারছে বাড়িয়ে দিচ্ছে। রোজার মৌসুমে দাম বাড়ানো রীতিতে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা বেড়েছে। যার চড়া মাসুল দিতে হয় ভোক্তাকে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
তিনি আরও বলেন, রোজার বাড়তি চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বাড়াতে বেশকিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাড়াতে এবং সহজ করতে সরকার অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এর সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না। ভোক্তারা যাতে সুফল ভোগ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার আনিতে শুল্কছাড় দিচ্ছে সেটাও যাতে কেবল ব্যবসায়ীরা ভোগ না করে, ভোক্তাপর্যায়ে সেটা পৌঁছাচ্ছে কিনা সেটাও তদারকি করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থার আরও উন্নত করতে হবে।