বিশ্বব্যবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা

জাহাঙ্গীর সুর
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিশ্বব্যবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা


মাত্র দুই দিনে কিয়েভ দখলের ‘দুঃস্বপ্ন’ দেখেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট- এই কথা তুলে ধরে উপহাসের শিরোনাম করতে খুব একটা দেরি করেনি মার্কিন গণমাধ্যমগুলো। যেমন তখন বিজনেস ইনসাইডার লিখেছিল, যুদ্ধ শুরুর ২০ দিন পরও ভøাদিমির পুতিনের অপচেষ্টা পূরণ হয়নি। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া দুই বছর দীর্ঘ এই যুদ্ধ নিয়ে এমন কথা বলতে গেলে সাত-পাঁচ ভাবতে হবে হাজারবার। মস্কোর মনোবাঞ্ছা ষোলোআনা পূরণ হয়েছে কিনা, এর চেয়ে গুরুত্ববহ জিজ্ঞাসা হলো : দুই বছরে ইউক্রেন এবং রাশিয়াসহ গোটা বিশ^ব্যবস্থায় কী প্রভাব ফেলেছে এই যুদ্ধ। সংক্ষেপে বলা যায়, ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান বা আগ্রাসন যে ধ্বংসাত্মক মানবিক ক্ষতি করেছে, তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ^ অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল; ইউক্রেন যুদ্ধ সেই আর্থিক দুর্দশাকে আরও ভয়াবহ ও গভীর করে তুলেছে। বৈশি^ক মেরুকরণ আরও বাড়িয়েছে, বিশ^কে অনিশ্চিত আগামীর দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবের ধাক্কা লেগেছে কিয়েভ থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে থাকা এই বাংলাদেশেও।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের বর্বর আগ্রাসনের কারণে সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বর্তমানে কিছুটা কম আলোচনা দেখা যায়। তবে এর ধ্বংসাত্মক ধাক্কা আরও বড় হচ্ছে। ইউক্রেনীয়দের নিপীড়ন, যুদ্ধের সময় রুশ অধিকৃত অঞ্চলে ইউক্রেনীয় জাতিসত্তার পরিচয় নিধন, সর্বোপরি ধ্বংসযজ্ঞের সার্বিক চিত্র বলছে- ইউক্রেনে রাশিয়া গণহত্যা চালাচ্ছে; যেমনটা এখন গাজায় গণহত্যা চালাতে দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলকে।

বেসামরিকদের প্রাণহানি

ইউক্রেনে কতজন মানুষ যুদ্ধে মারা গেছে, এ নিয়ে হালনাগাদ ও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না। এ নিয়ে আলোচনাও কম। গত

নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির খবর নিশ্চিত করতে পেরেছে জাতিসংঘ। কিন্তু এ সংখ্যাটা আসলে সাগরে ডুবে থাকা বরফখ-ের মতো : ১২ ভাগের মাত্র এক ভাগ দেখা যায়, ১১ ভাগই জলের তলে অদৃশ্য থাকে। যেমন স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, ২০২২ সালে মাত্র তিন মাসে মারিউপোলে ২২ হাজার থেকে ৮৭ হাজার পর্যন্ত মানুষ নিহত হয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধাপরাধ কৌঁসুলির মতে, এই যুদ্ধে কমপক্ষে এক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইউক্রেনের সরকার নিহতের সংখ্যা কেন খোলাসা করে বলে না, এর একটা কারণ হতে পারে, জাতি মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারে।

সামরিক হতাহত

বেসামরিক প্রাণহানির পাশাপাশি দুই দেশের নিহত সেনাদের কথাও ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। তবে দুই দেশ এ নিয়ে মুখ খোলে না। যুক্তরাষ্ট্রের অনুমান হচ্ছে, রাশিয়া এক লাখ ২০ হাজার সেনা হারিয়েছে, ইউক্রেন হারিয়েছে ৭০ হাজার সেনা। নিহত ও আহত মিলিয়ে ওয়াশিংটনের অঙ্ক বলছে, এই সংখ্যা পাঁচ লাখের কম নয়।

মানবিক বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর ৬৫ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে গেছেন। দেশের ভেতর বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও ৩৫ লাখ ইউক্রেনীয়। এরা ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ। এ ছাড়া ১ কোটি ৭৬ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন, এদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ ‘চরম বিপর্যয়ে’ রয়েছেন।

অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ইউক্রেনের ১০ শতাংশ বাড়িঘর, ৩৬০০ শিক্ষালয় ও ৮৪০০ কিলোমিটারের সড়ক ধ্বংস হয়ে গেছে। দেড় হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রায় পাঁচ হাজার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনায় হামলা হয়েছে। এতে দেশটির অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ ধসে গেছে।

ভূখ- অধিগ্রহণ

রাশিয়া এই মুহূর্তে ইউক্রেনীয় ভূখ-ের ১৮ শতাংশ দখল করে আছে। এই অঞ্চলগুলো যোগ করলে দক্ষিণ কোরিয়ার সমান হবে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর পুতিন বলেছিলেন, তিনি কিয়েভকে চাইলে দুই সপ্তাহে দখল করতে পারেন। যা হোক, ২০২২ সালে চারটি অঞ্চল দখল করেছে রুশ বাহিনী, কিয়েভ আছে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণেই। অধিগৃহীত এসব অঞ্চলে ইউক্রেনীয়দের জোর করে রুশ পাসপোর্ট ধারণ করতে বলা হয়, নইলে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, ক্রিমিয়ায় ১০ লাখের বেশি রুশকে বসতি স্থাপন করতে পাঠিয়েছে মস্কো।

রুশ অর্থনীতিতে ধাক্কা

রাশিয়া এরই মধ্যে শত শত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে। গতকালও যুক্তরাষ্ট্র ৫০০ রুশ টার্গেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যদিও প্রতিবারই মস্কো পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেয়। রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকের ২৬ হাজার কোটি ইউরো জব্দ হয়েছে। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশের সাথে রাশিয়ার বিমান যোগাযোগ বন্ধ আছে। নিষেধাজ্ঞা অনুসারে, রাশিয়ার কাছে এমন কিছুই বিক্রি করা যাবে না যা রুশ সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে পারে। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব তো পড়েছেই, রুশ জিডিপি প্রত্যাশার চেয়ে অন্তত ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, রুশ অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি। বরং দুই দিন বা দুই সপ্তাহ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে অর্থনীতিকে এক রকম চাঙ্গাই করেছে যেন মস্কো। বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, এ বছর রুশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ২.৬% যা যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চেয়ে বেশি। বাজেট ঘাটতিও যুক্তরাজ্য ও ইইউর থেকে কম।

বিশ^ব্যাপী জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি

যুদ্ধের জন্য ‘উত্তম সময়’ বলে কিছু নেই। কিন্তু এরপরও ইউক্রেনে যে সময় রাশিয়া পূর্ণ মাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করেছিল, তা ছিল নিষ্ঠুর। কোভিড মহামারীর দুই বছরের ধাক্কা কোনোমতে সামলে উঠতে চেষ্টা করছিল দেশগুলো। তখনই খাদ্যপণ্যসহ সবকিছুরই দাম বৃদ্ধি হচ্ছিল। রুশ আগ্রাসনে তা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে শুরু করে। বিশেষ করে খাদ্য ও জ¦ালানি খাতের চিত্রটা জটিল ও অমানবিক হতে থাকে। মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বিশ^ব্যাপী মানুষের স্বাস্থ্যে এবং মানসিক সুস্থতায়। বিশেষ করে গরিব মানুষ আরও কঠিন চাপে পড়েছে, দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছে অধিকতর দরিদ্র অঞ্চলগুলো।

বৈশি^ক খাদ্য অনিরাপত্তা

যুদ্ধের আগে ইউক্রেন ও রাশিয়া ছিল বিশে^ গমের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। দুইয়ে মিলে বিশে^র ৩৬ শতাংশ গমের চাহিদা মেটাত। বিশ^ব্যাপী সূর্যমুখী তেলের যে চাহিদা, এর অর্ধেকই মেটাত দেশ দুটো। যুদ্ধ শুরুর পর এই চিত্র বদলে গেছে। উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতিগুলো আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। কেননা তারা এই দুই দেশের জ¦ালানি ও খাদ্যশস্যের ওপর নির্ভর করত। ছবিটা পাওয়া যাবে এই তথ্য থেকে : ২০২১ সালে খাদ্য সংকটে ভুগত ৫৩ দেশের ১৯ কোটি ৩০ লাখ মানুষ, ২০২২ সালে খাদ্য সংকটে ভুগেছে ৫৮ দেশের ২৫ কোটি ৮০ লাখ মানুষ।

জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধি

রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানির মূল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধের দুই সপ্তাহের মধ্যেই ইউরোপিয়ান অয়েল বেঞ্চমার্কের মূল্য ২৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস না নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু নর্ড স্ট্রিম ১ ও ২- এ দুটোর ওপরই হামলা হয়েছে। তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার পর যে বিকল্পগুলো আছে, সেগুলো বরং আরও বেশি খরচসাপেক্ষ। ইইউ রুশ তেলের বড় আমদানিকারক। ফলে যুদ্ধের পর নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ^ব্যাপী তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। এর প্রভাব সর্বস্তরে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

রাশিয়ার সীমান্তঘেঁষা দেশগুলোকে বশ করে সেখানে সেনা ঘাঁটি গাড়ার পাঁয়তারা করছে পশ্চিমা দেশগুলোর জোট ন্যাটো- এই আশঙ্কায় ইউক্রেন সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশটিতে অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন পুতিন। সেই যুদ্ধ থামেনি। উভয় পক্ষই জয়ের জন্য আশাবাদী। কিন্তু মাঝখান থেকে জীবন ঝরে যাচ্ছে অসহায়, নিরীহ মানুষের। আর সেই যুদ্ধের খেসারত দিতে হচ্ছে সারাবিশে^র মানুষকেই। এই ধাক্কা সামলে ওঠা বড় চ্যালেঞ্জ।