বিশ্ব সংকট কাটিয়ে উঠলেও দেশে আরও প্রকট হয়েছে

জিয়াদুল ইসলাম ও রেজাউল রেজা
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিশ্ব সংকট কাটিয়ে উঠলেও দেশে আরও প্রকট হয়েছে

দুই বছর আগে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতি এ সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠলেও দেশে তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের জেরে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ দেশে ডলারের দাম লাগাতার বেড়ে যায়। সেই সংকট এখন আরও প্রকট হয়েছে; বেড়েছে ডলারের দাম। বর্তমানে প্রতি ডলারে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে ১২৫ টাকা পর্যন্ত। অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভের পতনও থামানো যায়নি। বর্তমানে দেশের মোট রিজার্ভ কমে ২৫ বিলিয়নে নেমেছে। আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী তা ২০ বিলিয়নের ঘরে রয়েছে।

দেশের অর্থনীতির অন্যতম খুঁটি রপ্তানি খাত। কিন্তু এ খাতে গতি নেই। আরেকটি খুঁটি রেমিট্যান্স। এ ক্ষেত্রে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স আশানুরূপ বাড়ছে না। এসব সংকটের মধ্যে কড়াকড়ি আরোপের কারণে আমদানি একটানা কমেছে। এতে বিনিয়োগে ভাটা পড়ছে; পণ্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। এ ছাড়া এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চাপে রয়েছে সাধারণ মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতিতে আগে থেকেই সংকট ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সেটি তীব্র হয়েছে। তবে বিশ্ব অর্থনীতি এ সংকটের মধ্য দিয়েই নতুন করে এগিয়ে চলছে। অনেক দেশই রিজার্ভ ও ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতির মতো সমস্যাগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।

সমস্যা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বরং যে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে সংকট আরও প্রকট হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বর্তমানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সংকটগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার জন্য এখন আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ এ দুই দেশের মধ্যকার সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন ‘নিউ নরমাল’ হয়ে গেছে। এ যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে সব প্রভাব পড়েছিল তা অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা গেছে। কিন্তু আমরাই পারিনি। উল্টো আমরা যে সব পদক্ষেপ নিয়েছি তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এখন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া যেগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোও যথেষ্ট নয়।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আমাদের অন্যতম মূল সমস্যা ডলার সংকট। কেন এই সংকট- সেটাই ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারিনি। রিজার্ভের পতন থামানো যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কেতাবি পন্থা অনুসরণ না করে এতদিন নিজস্ব কায়দায় সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়েছে যা কাজে তো আসেইনি, উল্টো সমস্যা বাড়িয়েছে; মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত বছর তেমন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বর্তমানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতেও জড়তা দেখা যাচ্ছে। ডলারের মূল্য এখনো বাজারভিত্তিক হয়নি। সুদের হারে সীমা তুলে দেওয়া হলেও এখনো সেখানে নিয়ন্ত্রণ দেখা যাচ্ছে। ফলে নতুন কৌশল নেওয়া হলেও সুফল মিলছে না, একই সমস্যা থেকে যাচ্ছে।

আগামীকাল ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পূর্ণ হবে। ২০২২ সালের এই দিনে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এ সংঘাতে ইউক্রেনকে সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ে বিশ্ববাজারে। যুদ্ধের জেরে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যায়, সরবরাহব্যবস্থা বিঘিœত হয়, ব্যয়ও বাড়ে। এর প্রভাবে বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বাড়তে থাকে। বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি কর্মসূচির সূচক রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। এক পর্যায়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কারও কথা জানায়। কিন্তু মন্দা না হলেও নানামুখী চাপের মুখে পড়ে অর্থনীতি, যা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

দেশের অর্থনীতির উত্তরণে সর্বপ্রথম নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ, ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়মসহ নিজস্ব কিছু দুর্বলতার কারণে অর্থনীতিতে সংকট আরও প্রকট হয়েছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন। আইএমএফের ঋণের ইস্যুতে অনেকগুলো সংস্কারের বিষয় সামনে এসেছে। আগেও এসব সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি আর্থিক খাতে বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হতে হবে।

রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি : গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের টানা পতন অব্যাহত ছিল। আর ডিসেম্বর মাসে আইএমএফ ও এডিবির ঋণে ভর করে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছিল। তবে চলতি অর্থবছরে এসে আবার পতনের ধারায় ফিরেছে রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর সময় দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। সেই রিজার্ভ কমতে কমতে গত ২০ ফেব্রুয়ারির হিসাবে ঠেকেছে ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছরে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২০ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এদিকে আইএমএফের বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে এখন রিজার্ভ নেমেছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। যদিও নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের চেয়েও ৩ বিলিয়ন ডলার কম।

কাটেনি ডলার সংকট, বেড়েছে দাম : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর শুরু হওয়া ডলার সংকট এখনো কাটেনি। ফলে শৃঙ্খলা ফিরেনি ডলারের দামেও। চলমান সংকটের মধ্যেই গত বছরের শেষ সময়ে তিন দফায় ডলারের আনুষ্ঠানিক দর প্রায় ১ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করে বাফেদা ও এবিবি। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের দর ঠিক করা হয়েছে ১১০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই দামে ডলার মিলছে না। আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারে ১২২ থেকে ১২৫ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম উঠেছে ১২৪-১২৫ টাকা।

জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও প্রবাসী আয়ে গতি কম : গত দুই বছরে দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু এর খুব বেশি প্রতিফলন নেই প্রবাসী আয়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) প্রবাসী আয়ে মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে প্রবৃদ্ধি হয় পৌনে ৩ শতাংশ।

রপ্তানি আয়ে ধীরগতি : যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩০ শতাংশ। সেখানে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সেই প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ।

আমদানি নিম্নমুখী, বেসরকারি বিনিয়োগেও ভাটা : যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সার্বিক আমদানিতে ৫৪ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এর মধ্যে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বেড়েছিল যথাক্রমে ৬৭ শতাংশ, ৬০ শতাংশ ও ৫০ শতাংশ। সেখানে গত অর্থবছরে সার্বিক আমদানি কমে দাঁড়ায় প্রায় ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে এই তিনটি পণ্যের আমদানি কমে যথাক্রমে সাড়ে ৩৬ শতাংশ, সাড়ে ২৩ শতাংশ ও ১৪ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সার্বিক আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে এই তিন পণ্যের আমদানি কমেছে যথাক্রমে সাড়ে ২৬ শতাংশ, ১০ শতাংশ ও ৩১ শতাংশ। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণেও ধীরগতি চলছে। এ জন্য চলতি মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান আরও কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।

এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। এ যুদ্ধ শুরুর আগের মাসেও (জানুয়ারি, ২০২২) দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে চড়তে ওই বছরের আগস্টেই তা সাড়ে ৯ শতাংশে ওঠে। আর ২০২৩ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ১৩৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। এরপর মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

এ যুদ্ধের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে তা সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর খরচের চাপ অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এ যুদ্ধের অভিঘাতে প্রথম ধাপে মানুষের জীবনমান কমেছে। করোনার পর বিপর্যস্ত মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠছে না। জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখনো মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের। জিনিসপত্রের দামে স্বস্তি দিতে সবার আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা নীতির দিকে নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থারও উন্নতি করতে হবে।