স্মৃতির মিনারে পুষ্পিত শ্রদ্ধা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত

নিজস্ব ও ঢাবি প্রতিবেদক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্মৃতির মিনারে পুষ্পিত শ্রদ্ধা

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে পথ সালাম-বরকত-রফিক-শফিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, গতকাল সেই পথ ছেয়ে গেল শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে। শ্রদ্ধা জানাতে আগতরা অবনত মস্তকে একযোগে গাইলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। দিবসটিতে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাতে যোগ দেন অনেক বিদেশিও। লাখো মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় বিশ্বজুড়েও দিবসটি পালিত হয়।

গতকাল একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। আর এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে ২১তমবার শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণের ছবি নিয়ে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফুল দেওয়ার পর দলীয় নেতাদের নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা, সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান শহীদ বেদিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা জানান ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতারা, ঢাকার বিভিন্ন মিশনের কূটনীতিকরাসহ ঢাকার দুই সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম। সহকর্মীদের নিয়ে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল শ্রদ্ধা জানানোর পর সর্বসাধারণের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ খুলে দেওয়া হয়।

ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি আজিমপুরে ভাষাশহীদদের কবরেও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এবারও প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে অনুপস্থিত ছিল বিএনপি। এ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে শহীদ মিনারে জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাসদ, সিপিবি, ঐক্যন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ (উত্তর ও দক্ষিণ), ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, শ্রমিক কর্মচারী লীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ফুলেল শ্রদ্ধা জানায়।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশের একমাত্র বাধা সাম্প্রদায়িকতা। বিএনপির নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ ডালপালা বিস্তার করেছে, এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটিত করব আমরাÑ এটাই আমাদের অঙ্গীকার। অন্যদিকে রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রভাতফেরি নিয়ে আজিমপুরে ভাষাশহীদদের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এরপর শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে রিজভী বলেন, আমরা আজকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভোটাধিকার হারা। যেভাবে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী আমাদের মাতৃভাষার অধিকার হরণ করেছিল। ঠিক একইভাবে আমাদের দেশীয় হানাদার বাহিনী জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ সব মৌলিক অধিকার হরণ করেছে।

শহীদ দিবস উপলক্ষে সকাল সাড়ে ১০টায় বায়তুল মোকাররমে কোরআনখানি, দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৭টায় আজিমপুর কবরস্থানে কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল এবং সকাল ৮টায় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এ ছাড়াও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ঢাবি সিনেট সদস্যবৃন্দ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী ফোরাম, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, জাতীয় হিন্দু মহাজোট, বাংলা একাডেমি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, ইউআইটিএস, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আইএসপিএবিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। দুপুরের আগেই ফুলে ফুলে ভরে ওঠে পুরো শহীদ মিনারের বেদি।

শুধু ঢাকায় নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, সিলেটসহ দেশের সব জেলায় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। বিদেশে বাংলাদেশের সব দূতাবাসের উদ্যোগেও দিবসটি পালিত হয়। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরÑ

চট্টগ্রাম : একুশের প্রথম প্রহরে নগরের মিউনিসিপ্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান চসিক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী। এরপর শ্রদ্ধা জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, ডিসি আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ও এসপি এসএম শফিউল্লাহ। এরপর পর্যায়ক্রমে শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো, পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা, ট্যুরিস্ট পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা, পাউবি, রেলওয়ে পুলিশ, চট্টগ্রাম জেলা আনসার কমান্ডার, ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম কারাগার ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ময়মনসিংহ : একুশের প্রথম প্রহরে ময়মনসিংহ নগরীর কেন্দ্রীয় টাউন হলে শহীদ মিনারে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান ময়মনসিংহ সদরের এমপি মোহিত উর রহমান শান্ত। এরপর একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া, রেঞ্জ ডিআইজি মো. শাহ আবিদ হোসেন, মসিকের সিইও মো. ইউসুফ আলী, ডিসি দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী, এসপি মাছুম আহাম্মদ ভূঞা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামূল আলম ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলসহ প্রমুখ।

দাগনভূঞা (ফেনী) : শ্রদ্ধা জানাতে উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের ভাষাশহীদ সালামনগরে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। সকাল থেকে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ফুল দিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানায়। ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর সংলগ্ন শহীদ মিনার ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। এ সময় তারা গ্রন্থাগার ও জাদুঘর এবং সালামের পৈতৃক বসতঘর ঘুরে দেখেন। জাদুঘর প্রাঙ্গণে দাগনভূঞা উপজেলা প্রশাসনের আলোচনাসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ফেনী-৩ আসনের এমপি লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ডিসি মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার সভাপত্বিতে এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন এসপি জাকির হাসান, দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউএনও নিবেদিতা চাকমা।

শরীয়তপুর : একুশের প্রথম প্রহরে শরীয়তপুর পৌরসভার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এমপি ইকবাল হোসেন অপু। এরপর পর্যায়ক্রমে ডিসি মো. পারভেজ হাসান, এসপি মো. সাইফুল হক, জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

রাজবাড়ী : একুশের প্রথম প্রহরে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খুশি রেলওয়ে ময়দানে অবস্থিত শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সভাপতি আলহাজ কাজী কেরামত আলী, ডিসি আবু কায়সার খান, এসপি জিএম আবুল কালাম আজাদ, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম টিটন, স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান রিপন, রাজবাড়ী জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি লিটন চক্রবর্তী প্রমুখ।

মাগুরা : একুশের প্রথম প্রহরে মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করেন মাগুরা-২ আসনের এমপি ড. বীরেন শিকদার, ডিসি মোহাম্মদ আবু নাসের বেগ, এসপি মশিউদ্দৌলা রেজা, মাগুরা-১ আসনের এমপি সাকিব আল হাসানের পিতা মাশরুর রেজা কুটিল, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ফাত্তাহ, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পঙ্কজ কুণ্ডু, পৌর মেয়র খুরশীদ হায়দার টুটুল, সদর ইউনও মো. মিজানুর রহমান প্রমুখ।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সকাল ৮টায় প্রভাতফেরি বের করা হয়। এটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে অস্থায়ী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। এ সময় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবদুল বাসেত।

বেরোবি : রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালে প্রভাতফেরি শেষে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. হাসিবুর রশীদ, উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. সরিফা সালোয়া ডিনা ও ট্রেজারার প্রফেসর ড. মজিব উদ্দিন আহমদ।

গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) : গজারিয়ার ভবেরচর ইউনিয়নের নয়াকান্দি গ্রামে ভিটিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার না থাকায় প্রতিবছরের মতো এবারও ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে বাঁশের তৈরি শহীদ মিনারে।