মৌসুমি লেখকদের বাজারই রমরমা

সাক্ষাৎকার ।। অদ্বৈত মারুত
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
মৌসুমি লেখকদের বাজারই রমরমা

কাজল রশীদ শাহীন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক। এবারের বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে তার দুটি প্রবন্ধের বই। বইমেলা ও লেখালেখি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আমাদের সময়ের সাহিত্য সম্পাদক অদ্বৈত মারুতের সঙ্গে।

আমাদের সময় : প্রথমেই জানতে চাচ্ছি- বইমেলার উদ্দেশ্য কি শুধুই বই বিক্রি?

কাজল রশীদ শাহীন : বইমেলার উদ্দেশ্য শুধু বই বিক্রি নয়; বইকে কেন্দ্রে রেখে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত রয়েছে বায়ান্নর একুশের চেতনা। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের যে আকাক্সক্ষা, তারও একটা চারিত্র্যকাঠামো হাজির রয়েছে এ মেলায়। ফলে মেলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেমন বহুমুখী, তেমনি তাৎপর্যও বিবিধ। এ কারণেই মেলা উপলক্ষে মাসব্যাপী সেমিনারের আয়োজন করা হয় বাংলা একাডেমির তরফে। রয়েছে ‘লেখক বলছি’-র মতো আয়োজন। দেওয়া হয় বাংলা একাডেমি পুরস্কারের মতো মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার। এই মেলার উদ্দেশ্য যে বহুমাত্রিক, তাতে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। বেদনার হলো এসব আয়োজনে গোষ্ঠীপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, অস্বচ্ছতা এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, সেমিনার থেকে পুরস্কার- সব জায়গায় মানুষের আস্থা একেবারে শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বইমেলার উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে শুধুই বই বিক্রি, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আমাদের সময় : বইমেলাকে লেখক-পাঠক-প্রকাশকের সেতুবন্ধ হিসেবে গড়তে কী ধরনের পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন?

কাজল রশীদ শাহীন : লেখক-প্রকাশকের মধ্যে সেতু গড়ে তুলতে উভয়পক্ষের মধ্যে পেশাদারি মনোভাব গড়ে তোলার সদিচ্ছা প্রয়োজন। সমস্যা হলো এ দুবর্গের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার মতো সম্মান প্রদর্শন ও নৈতিকতার চর্চা নেই। লেখক-প্রকাশককে বিশ্বাস করেন না। কারণ প্রকাশক লেখককে কোনো কিছু অবহিত করেন না, জবাবদিহিতার চর্চাও নেই। অন্যদিকে প্রকাশক মনে করেন, বই প্রকাশ করে লেখককে ধন্য করেছেন। এর পর আর লেখকের কোনো কিছু চাওয়া বা প্রত্যাশা নেই। এই বাস্তবতার মধ্যে কীভাবে লেখক-প্রকাশকের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠবে? এখানে তৃতীয় পক্ষ এগিয়ে এলে হয়তো এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। রাষ্ট্রের তরফে বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠান যদি তৃতীয় পক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করত, তা হলে হয়তো লেখক-প্রকাশক সম্পর্কের এতটা অবনমন ঘটত না।

আমাদের সময় : বইমেলা এলে মৌসুমি লেখক বাড়ে। বইয়ের বাজার সম্প্রসারণে এরা কী ভূমিকা রাখছে, নাকি বইয়ের বাজার ও পাঠক-রুচি নষ্ট করছে?

কাজল রশীদ শাহীন : মৌসুমি লেখকরা বইয়ের বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে। তবে এ সম্প্রসারণ ভালো কিছু নয়। এর মধ্য দিয়ে বইয়ের বাজার ও পাঠক-রুচিও নষ্ট হচ্ছে। বইবিমুখ একটা গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। ‘মৌসুমি’ জিনিসটাই ভালো কিছু নয়। কারণ এরা ক্ষণিকের জন্য আসে এবং স্বার্থ হাসিল করে চলে যায়। আমরা তাৎক্ষণিকতার মোহে পড়ে অনেক সময় এদের উৎসাহিত করি, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিই। আর এরা ওদের ধর্মটা পালন করে। প্রশ্ন হলো এদের প্রতিহত করবে কারা এবং কীভাবে? এদের প্রতিহত করার জন্য যে রাষ্ট্র-সমাজ-প্রতিষ্ঠান ও মানুষ তৈরির কথা ছিল, আমরা সেটি করতে পারিনি। কার কোনটা করা উচিত, আর কোনটা করা উচিত নয়, এই বোধ তৈরির উপাদান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। লেখক হওয়া যে একটা সাধনার ব্যাপার, দীর্ঘদিনের শ্রম-মেধা-ধৈর্য-অনুশীলন ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে যে একজন লেখক তৈরি হন, সেটি আমরা দৃশ্যমানভাবে হাজির করতে পারিনি। ফলে এখানে মৌসুমি লেখকদের বাজারই রমরমা। সেই বিবেচনায় বলা যায়, আমাদের বইয়ের বাজার স্রেফ আগাছার ক্ষেতে পরিণত হয়েছে। এখানেই আগাছা-ই মূলধারা, যা নিয়ে কারও কোনো হেলদোল আছে বলেও মনে হয় না।

আমাদের সময় : অনেকে বইয়ের মান নির্ধারণ বিষয়ে কথা বলেন। এটা কি আদৌ সম্ভব?

কাজল রশীদ শাহীন : বইয়ের মান নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, এটি কোনো কাজের প্রস্তাবও নয়। আমাদের গড় রুচি ও মানের অবনমন হয়েছে। এই অবস্থায় কে-কার মান নির্ধারণ করবে? শিক্ষাক্ষেত্রে যে সর্বনাশটা স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে, তার মাসুল দিচ্ছি আমরা। আগামীতে আরও দিতে হবে। শিক্ষার উন্নয়ন বলতে আমরা প্রথম থেকে মনে করে আসছি অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর সংখ্যাগত ধারণা। জ্ঞানসূচকসহ বিভিন্ন সূচকে আমাদের অবস্থান ও মান কেমন, তা আন্তর্জাতিকভাবে করা ফি বছরের সূচকে পরিষ্কারভাবে উঠে আসে। এসব আমরা কেবলই দেখি কিংবা বড় গলায় প্রত্যাখ্যান করি কিংবা বেহুদা তর্কে জড়াই। এসবে কি ওই অবনমন চিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটে? ঘটে না। দরকার ছিল, বিষয়টি আমলে নিয়ে, আশু পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নকে দায়িত্ব-কর্তব্য জ্ঞান করা। কিন্তু সেটা দেখা যায় না বললেই চলে। এই যে নানা ক্ষেত্রে আমাদের মেধা-রুচি ও মননের অবনমন ও যাচ্ছেতাই একটা অবস্থা, এসবেরই রুঢ বাস্তবতা হাজির রয়েছে বইমেলায়। ফলে কেবল পাঠকের নয়, লেখক-প্রকাশক-আয়োজক-নির্বাহক-সহযোগ-শুভানুধ্যায়ী-পৃষ্ঠপোষক সবার নিম্নগামী মন-মেধা ও রুচির উপস্থিতি আমরা বইমেলায় দেখতে পাই।

আমাদের সময় : এবারের মেলায় আসা আপনার বই নিয়ে কিছু বলুন।

কাজল রশীদ শাহীন : অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ আমার দুটি বই এসেছে। কালের ধ্বনি থেকে প্রকাশিত বইটির নাম, ‘বাংলাদেশের নবজাগরণ ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ : অন্বেষা-অবলোকন-তত্ত্ব’। পাওয়া যাচ্ছে ছোটপত্রিকা এলাকার কালের ধ্বনিতে। অন্য বইটির নাম, ‘প্রশ্নমঙ্গল : বুদ্ধিজীবীর অ আ ক খ’। এটি প্রকাশ করেছে বাংলানামা। পাওয়া যাচ্ছে বাংলানামার স্টলে। দুটোই প্রবন্ধের বই। প্রথম বইটি দীর্ঘদিনের গবেষণা-চিন্তা ও ভাবনা থেকে লেখা। এর বিষয় ‘বাংলাদেশের নবজাগরণ’। আমি ১৯২১ থেকে ১৯৭১ সময় পর্বে সংঘটিত নবজাগরণ সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পূর্ণ কলেবরের কাজটি আশা করি আগামী বইমেলায় আসবে।

দ্বিতীয় বইটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধের বই। সমাজ রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা কী, কেমন হওয়া উচিত, কেমনটা দেখা যাচ্ছে এ বিষয়গুলো এখানে উঠে এসেছে। একুশটা প্রবন্ধ রয়েছে এতে, যার কেন্দ্রে রয়েছে প্রশ্নের সদর্থক বিষয় ও এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিভিন্নজনকে নিয়ে সুলুকন্ধানী আলাপ।