ভাষা নিয়ে যত গল্প

আজহারুল ইসলাম অভি
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ভাষা নিয়ে যত গল্প

‘পৃথিবীতে মানুষই হলো একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা আছে, এই ভাষার কারণে আমরা অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা হয়েছি।’ এটি ভাষা সম্পর্কে নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাগি টলারম্যানের ভাষ্য। পৃথিবীতে যে বিবর্তন চলমান এই বিবর্তনের গুরত্বপূর্ণ নিয়ামক হচ্ছে ভাষা। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ সাড়ে ছয় হাজারের মতো ভাষায় কথা বলে। ভাষার মাসে আমাদের আজকের আয়োজন ভাষা নিয়ে। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজহারুল ইসলাম অভি।

বিশ্বের প্রাচীন কিছু ভাষা

হিব্রু

লিখিতভাবে প্রাপ্ত ভাষার ভেতর হিব্রু বেশ পুরনো একটি ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, হিব্রুর জন্ম আজ থেকে প্রায় ৩,০০০ বছর পূর্বে। ইহুদিদের প্রধান ভাষা হিসেবে হিব্রুর ব্যবহার ছিল এক সময়। তবে একটা সময় এসে হিব্রুর সাধারণ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, তখন থেকে এটি কেবল গুটিকয়েক মানুষের ভাষা হিসেবে টিকে ছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় কাজেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে পরবর্তী সময়ে ২০ শতকের দিকে যখন জায়োনিজমের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করে, তখন থেকেই হিব্রু ভাষা আবার জেগে ওঠে। বর্তমানে হিব্রু অস্থায়ী ইসরালে রাষ্ট্রের প্রধান ভাষাগুলোর মাঝে একটি। ইসরাইলের অন্তত পাঁচ মিলিয়ন মানুষ হিব্রু ভাষায় কথা বলে।

তামিল

এশিয়া মহাদেশের প্রাচীনতম একটি ভাষা হলো তামিল ভাষা। যার উৎপত্তি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২,২০০ বছর আগে। বর্তমানে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়াতে তামিল ভাষার ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলঙ্কাতে এটি সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ভারতে তামিল ভাষাভাষীর সংখ্যা ৮০ মিলিয়নের উপরে, যাদের ৯৫ শতাংশের প্রধান ভাষা এটি। বর্তমানে ৭টি দেশের মানুষ তামিল ভাষায় কথা বলে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে বর্তমানেও বেঁচে থাকা একমাত্র শাস্ত্রীয় ভাষার খেতাব কেবল তামিল ভাষার রয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে তামিল পৃথিবীর ২০তম প্রধান ভাষা।

ফারসি

পৃথিবীর অনেক মানুষ থাকতে পারেন, যারা ফারসি ভাষা সম্পর্কে জানেন না কিংবা এটির ব্যাপারে শুনেননি। তবে তারা ভাষার কথা না শুনলেও পারস্যের কথা ঠিকই শুনেছেন। এই কথা বলার কারণ হলো, ‘ফারসি ভাষা’ আর ‘পারস্য’ একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান ইরান, তাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তানসহ বেশকিছু দেশের মানুষ ফারসি ভাষায় কথা বলে। তাজাকিস্তান এবং উজবেকিস্তানে ফারসি ভাষাকে ‘তাজিক’ ভাষা বলা হয়। আফগানরা ফারসিকে বলে ‘দারি’। আর ইরানে ফারসিকে ফারসি ভাষাই বলা হয়। সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত ফারসি ভাষার শিলালিপিটি তৈরি করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫২২-৪৮৬ সালের ভেতর, যা রাজা দারিয়ুসের বলে বলে ধারণা করা হয়।

আরবি

আরবি সেমিটিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা, যেটি প্রাচীনকাল থেকে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর ২৭০ মিলিয়ন মানুষ এ ভাষায় নিজেদের ভাব বিনিময় করে থাকে। সেইসাথে জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ৫ম বৃহত্তম ভাষা। সৌদি আরবসহ বিশ্বের আরও ২৫টি দেশের মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে। মুসলিমদের কাছে আরবি যতটা না ভাষা, তারচেয়ে বেশি ধর্মীয় ভাবাবেগের একটি ব্যাপার। এই ভাষাতেই ‘কুরআন মাজিদ’ নাযিল হয়েছিল। যার কারণে আরব বিশ্বের যেখানেই ইসলাম স্থান করে নিয়েছে, সেখানেই আরবির প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে একসময় আরবি উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। অনেক ইউরোপিয়ান ভাষা আরবি ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যার কারণে তাদের শব্দভাণ্ডারে আরবি ভাষার শব্দ জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়া হিন্দি, বাংলা, উর্দুসহ অনেক দেশের ভাষার সঙ্গে আরবি ভাষার শব্দ মিশে গিয়েছে।

কৃত্রিম ভাষা

হাল আমলে টেলিভিশন কিংবা বইয়ের গল্পের প্রয়োজনে কৃত্রিম ভাষার সৃষ্টি করা হয়েছে। চলুন জেনে আসি কিছু কৃত্রিম ভাষার কথা-

এলিয়েনিজ : ফিউচারামা

এলিয়েনদের ভাষা হিসাবে আবিষ্কৃত এলিয়েনিজ খুব সম্ভবত সবথেকে সহজ ভাষা। অবশ্য তার জন্য গণিতে ধারণা থাকতে হবে। ফিউচারামা নামের এনিমেটেডে সিরিজে ভাষাটা ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজির সাথে খাপ খাইয়ে ২৬টি চিহ্নের প্রবর্তন করা হয় প্রথমে। ভক্তেরা তাকে সাদরে গ্রহণ করলে আরেকটু এগিয়ে দ্বিতীয় রূপটাতে প্রবেশ করা হয় গাণিতিক বিশ্লেষণের সহযোগে।

ল্যাপিন : ওয়াটারশিপ ডাউন

রিচার্ড এডামস্ ১৯৭২ সালে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়াটারশিপ ডাউন’ রচনা করেন। রচনার অন্যতম আকর্ষণ খরগোশকে দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় কথা বলানো। ফরাসি শব্দ ল্যাপিন-এর অর্থ খরগোশ; মাঝে মাঝে খরগোশ সমাজ বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৬ সালে লেখকের পরবর্তী সিকুয়েল ‘টেইলস ফ্রম ওয়াটারশিপ ডাউন’-এও ভাষাটাকে অকপটে সামনে আনা হয়েছে। রিচার্ড এডামস্ মাত্র কয়েক ডজন শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার লেখায়। কিন্তু পরবর্তীতে তার সমর্থকেরা একে পৃথক ব্যকরণ এবং শব্দভাণ্ডারসহ কার্যকরী এক ভাষাতে পরিণত করে। “ঙং ব ষধুঃয ঋৎরঃযুববৎ যুধড়হবং, ড়হ ষধুঃয ুধুহ ুধুহ ফধযষড়রষ.”Íপ্রচণ্ড রোদ পড়েছে আজ। আমরা ফুল খুঁজতে বের হব।

না’ভি : অ্যাভাটার

বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরুন তার সৃষ্টিশীলতার নজির অনেক আগেই রেখেছেন। ২০০৯ সালে অ্যাভাটার ছিল সেই তকমাকে আজীবনের জন্য পাকাপোক্ত করা। সিনেমাটিতে একটা আলাদা জাতি না’ভিকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একটা স্বতন্ত্র ভাষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সঠিক সময়ে তাকে সাহায্য করেন ভাষাবিজ্ঞানী বন্ধুবর পল ফ্রমার। তিনি বিস্তৃত শব্দভাণ্ডার আর ব্যকরণের মধ্যদিয়ে জন্ম দিলেন নতুন এক প্রকাশভঙ্গির। আর দর্শক-ভক্তরাও দ্রুত তা গ্রহণ করল। পল ফ্রমারের সহযোগিতাতেই ভাষাটির আরো অগ্রগতি সাধন করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ‘ঋধুাৎৎঃবঢ় ভল্ডঃংবহমব ষঁ শীধহল্ড. ঋল্ডঢ়ড়ঃর ড়বষ ঃংঢ়ল্ডুধহম, ভঃব ঃল্ডশবহড়হম ষরুবাঁ ধুষধৎঁ.’ দানব এখানে নিষিদ্ধ। আমি একে খুন করব পরবর্তীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

ডথরাকি : গেইম অব থ্রোনস

জর্জ আর আর মার্টিন তার বেস্টসেলার মহাকাব্যিক আখ্যান ‘এ সং অব আইস এন্ড ফায়ারস্’-এ অশ্বারোহী যাযাবার গোষ্ঠী ডথরাকির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বইটাতে মার্টিন অল্প কিছু শব্দও উল্লেখ করেন তাদের ব্যবহৃত ভাষার। কিন্তু পরবর্তীতে এইচভিও টেলিভিশন সিরিজ ‘গেইম অব থ্রোনস’-এ ডেভিড পিটারসন কয়েকটি শব্দ থেকে একটি স্বতন্ত্র ভাষাকেই বের করে আনেন।

পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত কিছু ভাষা

তুশিরো

২০০৮ সালের গবেষণামতে, মাত্র একজন লোক আছেন যিনি তুশিরো ভাষায় কথা বলতে জানেন। এটি ল্যাটিন আমেরিকার দেশ পেরুর একটি উপজাতীয় সম্প্রদায়ের ভাষা। পেরু-ইকুয়েডরের সীমান্তবর্তী নদী টিগরা ও আওচায়াকোর আশপাশে এ ভাষার জন্ম। তুশিরো এখন পৃথিবীর অন্যতম বিচ্ছিন্ন ভাষা। তুশিরোর নিকটবর্তী অন্য ভাষাগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই। গবেষণা অনুযায়ী ১৯৬১ সালে তুভার, ১৯৬৮-তে লৈকটকা, ১৯৯৪-তে কাউফম্যান ভাষা হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এগুলো ছিল তুশিরোর নিকটবর্তী ভাষা।

কায়জানা

ব্রাজিলের জাপুরা নদী অববাহিকার একটি গ্রামের ভাষা ছিল কায়জানা। পরবর্তীতে এখানে পর্তুগীজ উপনিবেশ গড়ে। ফলে হারিয়ে যেতে থাকে কায়জানা ভাষা। একসময় দেখা যায়, স্থানীয় ২০০ লোক এ ভাষায় কথা বলছে। সর্বশেষ ২০০৬ সালের গবেষণায় জানা যায়, ওই জাপুরা নদী অববাহিকায় আর মাত্র ১ জন লোক আছেন যিনি কায়জানা ভাষা জানেন।

লেমেরিগ

প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ১ হাজার মাইল উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপদেশ ভানুয়াতু। ভানুয়াতুর একটি দ্বীপের নাম ভানুয়ালাভা। এখানে মূলত আদিবাসীরা বাস করেন। ২০১০ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, বিলুপ্ত হতে চলেছে লেমেরিগ ভাষা। আর মাত্র ২ জন লোক আছেন ওই দ্বীপে যারা লেমেরিগ ভাষায় কথা বলেন। লেমেরিগ ভাষার আরও কিছু নাম রয়েছে। যেমন: পাক, বেক, সাসার, লেওন, লেম।

সেমেহুয়েবি

সেমেহুয়েবি মূলত রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষা। আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা এ ভাষায় কথা বলত। ২০০৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীতে আর ৩ জন লোক আছে যারা সেমেহুয়েবি ভাষায় কথা বলতে জানে। এ ভাষাটিতে কথা বলত মূলত কলোরাডো, অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া ও দক্ষিণ নেভাডা অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দারা।

নেজরেপ

নাইজেরিয়ার আদিবাসীদের ভাষা এটি। বিলুপ্তপ্রায় এ ভাষাটির অস্তিত্ব একসময় ক্যামেরুনেও দেখা গিয়েছিল অল্পসময়ের জন্য। ২০০৭ সালের এক গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, আর ৪ জন লোক রয়েছেন ওই অঞ্চলে যারা নেজরেপ ভাষায় কথা বলেন। নেজরেপ ভাষার খুব কাছাকাছি একটি ভাষা ম্যামবিলা ভাষা। জানা যায়, নেজরেপ ভাষা ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে ম্যামবিলা ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়ছে।

তানেমা (তানিমা, তেবায়ো)

ওশেনিয়া মহাদেশের দেশ সলোম্যান দ্বীপপুঞ্জ। সলোম্যান দ্বীপের তেমোতু রাজ্যে অবস্থিত ভ্যানিকোলা নামের একটি দ্বীপ। এ দ্বীপের একটি গ্রামের নাম ইমুয়া। এ গ্রামের বাসিন্দাদের ভাষা ছিল তানেমা, যা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ২০০৮ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, এ ভাষায় এখন কথা বলছেন মাত্র ৪ জন মানুষ। এ ভাষার নিকটবর্তী আরও দুটি ভাষা রয়েছে পিজিন ও তেনু নামে। গবেষকরা বলছেন, তানেমা ভাষা এই পিজিন ও তেনুতে হারিয়ে যাচ্ছে।

লিকি

মোয়ার নামে অন্য আর একটি নাম রয়েছে এ ভাষার। ইন্দোনেশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল সার্মি, জায়াপুরা কাবুপাতেন ও সার্মি কেচেমাতেন নামের গ্রামগুলোতে এ বিলুপ্ত প্রায় ভাষায় কথা বলছে কিছু লোক। জানা যায়, এই তিন অঞ্চলে মাত্র ৫ জন লোক রয়েছে, যারা লিকি ভাষাভাষী। অর্থাৎ প্রায় বিলুপ্তির পথে এ ভাষা।

অংগোটা

ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, অংগোটা মূলত আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা। এ ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায়। বায়তো নদী অববাহিকার পশ্চিম তীরে অংগোটা ভাষাভাষী লোকদের বাস ছিল। জানা যায়, ওই অঞ্চলে আর ৬ জন বৃদ্ধ মানুষ রয়েছেন যারা এ ভাষায় কথা বলেন।