বাড়ি কিনতে ৯৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন বেসিকের বাচ্চু
শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে এক যুগ আগে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকায় ৩০ দশমিক ২৫ কাঠা জমির ওপর নির্মিত একটি বাড়ি ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছিলেন; কিন্তু দলিলে মূল্য দেখান মাত্র ১৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বাকি ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমির মালিককে পরিশোধ করা হয় অন্যভাবে। এসব অর্থ ১২৬টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। বাচ্চুর একক কর্তৃত্বে বেসিক ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে সেসব ঋণের একটি অংশ ঘুষ হিসেবে নিজে সরাসরি গ্রহণ না করে জমির মূল্য হিসাবে পরিশোধ করেছেন।
ওই জমি কিনে ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আত্মাসাৎ ও পাচার এবং জমির মূল্য কম দেখিয়ে দলিল করে সরকারের ৮ কোটি ৫২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলার তদন্তে ঘুষের টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধের তথ্য উঠে এসেছে। তবে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ আদালতে বিশ^াসযোগ্য করে উপস্থাপনের জন্য আরও নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন বলে জানা যায়।
দুদকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, ‘আবদুল হাই বাচ্চু নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এখানে তিনি ঘুষের অর্থ নগদে গ্রহণ না করে সেই অর্থ তার কেনা জমির মূল্য পরিশোধ করতে ঋণগ্রহীতাদের বলেছেন। প্রাথমিকভাবে তদন্তে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এখন যেসব ঋণগ্রহীতার হিসাব থেকে ওই ১২৬টি পে-অর্ডার জমির মূল্য পরিশোধে ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।’
২০১২ সালে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার শহীদ সরণিতে অবস্থিত ওই বাড়ি ক্রয় করেন বাচ্চু। বাড়িটি কেনা কেন্দ্র করে গত বছরের ৩ অক্টোবর ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক মো. নুরুল হুদা। মামলায় শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ছাড়াও তার স্ত্রী শিরিন আক্তার, ছেলে শেখ রাফা হাই ও শেখ ছাবিদ হাই অনিক, বাচ্চুর ভাই শেখ শাহরিয়ার পান্না ও আমিন আহমেদ নামের আরেকজনকে আসামি করা হয়। আমিন আহমেদের কাছ থেকে ওই জমি কিনে বাচ্চু তার পরিবারের সদস্যদের নামে দলিল করেন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ২০১০ সালে যখন রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখনই ব্যাংকটির কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালে বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৫৬টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় ১২০ জনকে আসামি করা হলেও সেই তালিকায় ছিল না ঋণ কেলেঙ্কারির মূল হোতা আবদুল হাই বাচ্চুর নাম। এ নিয়ে নানা মহলের সমালোচনার মধ্যে মামলাগুলোর তদন্তের অংশ হিসেবে বাচ্চুকে পাঁচ দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। আলোচিত বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির মামলাগুলোর তদন্ত আট বছর থমকে ছিল। অবশেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের ১২ জুন ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্র অনুমোদন দেয় দুদক। এসব মামলার মধ্যে একটি ছাড়া ৫৮টিতেই আবদুল হাই বাচ্চুকে প্রধান আসামি করা হয়। বাচ্চু ছাড়াও পলাতক ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামসহ মোট ১৪৫ জনকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা ও ১০১ জন গ্রাহক।
আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের আট মাস পর আগামী মার্চ মাসে এসব মামলা আদালতে উঠছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশেষ দায়রা জজ আদালতে দুদকের দায়িত্বরত আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এই মার্চের বিভিন্ন তারিখে মামলার চার্জশিটগুলো আদালতে উঠবে। আদালত যদি সেগুলো আমলে নেন, তার পর থেকে সেগুলোর বিচার কার্যক্রম প্রক্রিয়া শুরু হবে। অভিযোগ আমলে নেওয়ার সময় যদি আসামি উপস্থিত না থাকে, তখন কোর্ট থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু হবে। এখনো তদন্ত কর্মকর্তা ইচ্ছে করলে প্রয়োজনবোধে আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেন।’
এদিকে দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘মামলা তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ অবস্থায়
তদন্ত কর্মকর্তার আর কিছু করার থাকে না। পরে পদক্ষেপের জন্য আদালতের আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আসামি কারাগারে থাকবে কিনা, সেটিও আদালতের ওপর নির্ভর করছে।’
তবে দুদক অভিযোগপত্র অনুমোদন করার পর সেসব মামলা থেকে আগাম জামিন চেয়ে গত বছরের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। কিন্তু ওই সব আবেদন করলেও সেগুলো নিয়ে আদালতে আর ‘মুভ’ করেননি বলে জানিয়েছেন উচ্চ আদালতে দুদকের দায়িত্বরত অন্যতম আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে, তার সম্পত্তি জব্দ করার পাশাপাশি তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্যও আবেদন দেওয়া আছে। তিনি যেহেতু জামিনও নেননি, সেহেতু আইনের দৃষ্টিতে তিনি এখন পলাতক।’
শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে তাকে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করার পর চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে দুদক।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন