বই-ই দিতে পারে অনাবিল সুখ

অদ্বৈত মারুত
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বই-ই দিতে পারে অনাবিল সুখ

গতকাল ছিল বসন্ত দিন, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে, সরস্বতী পুজো। তিনটি দিবস একসঙ্গে হওয়ায় ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তরুণ-তরুণীই বেশি। কারও কারও হাতে রক্তগোলাপ। বেশির ভাগের মাথায় টায়রা। অনেকেই মেলায় এসেছেন হলুদ শাড়ি পরে। বাসন্তী রঙের শাড়ি। ‘বাসনা বসে মন অবিরত,/ ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।/ স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত/ জাগিছ শয়নে স্বপনে’ রবীন্দ্রনাথের ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে’ থেকে মৌরি সুমনের হাতের ভেতরে হাত রেখে আবৃত্তি করতে করতে হাঁটছিল। ‘আজ আমাদের উড়বার দিন, আনন্দের দিন’ বলে সুমন মৌরির দিকে তাকাল। ‘হ্যাঁ, তাই তো! এই দিনেই তো আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম এই বইমেলায়’ বলে সায় দিল। ওরা বই কিনবে। নতুন লিখিয়ে কবির বই খুঁজতে বেরিয়েছে। সুমনের ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে অনেক কবি বন্ধু। দুয়েকজনের কবিতা যে ভালো লাগে না, তা নয়। তাদের বইয়ের ছবিগুলো মোবাইলে ধরে রেখেছে। আপনাতত সেগুলোই কিনবে। মৌরির পছন্দ সিরিয়াস ধরনের বই। ‘পুতুপুতু প্রেমের কচকচানি মার্কা’ বই সে পছন্দ করে না। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, ‘ভাই রে, বাস্তব জীবনটা অন্য রকম। পুতুপুতু প্রেম এই বাস্তবতার মধ্যে একদম খেলো ছাড়া আর কিছু নয়!’ অবন্তির বই কেনার তালিকা তাই দীর্ঘ। কার বই নেই! মেহতাব খানম থেকে শুরু করে আফসানা বেগম- সবই আছে।

দুজনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে প্রথমেই ঢুঁ মারা হলো ইউপিএলের প্যাভিলিয়নে। হাতে তুলে নিলাম মেহতাব খানমের ‘মন ও মানসিকতা’। মন নিয়ে কত চমৎকার বিশ্লেষণ! পড়তেই মনটা চাঙা হয়ে উঠল। কিন্তু মন আসলে কী? এক অধরা? মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর গতি নিয়ন্ত্রিত হয়। মস্তিষ্ক ও অন্তরের সংযোগ স্থাপনও করে দেয় এই মন। মনের আয়নায় সব দেখা যায়, যদি মন ভালো থাকে। কারণ মনেরও মনখারাপ হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু কেন? এর জবাব দিতে পারেন ড. মেহতাব খানম। তিনি আমাদের সমাজের চলমান ঘটনা থেকে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার উদাহরণ টেনে বের করেন। আপাতদৃষ্টে আমাদের এড়িয়ে চলা অতি তুচ্ছ বিষয়ের মধ্য থেকে প্রায়ই আচরণগত সমস্যাগুলো অবলীলায় চিহ্নিতও করেন। এসব সমস্যা থেকে নিজের চেষ্টায় কীভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব, তার বিজ্ঞানসম্মত পথও বলে দেন। প্রয়োজনে তিনি ঘটনার আরও গভীরতর বিশ্লেষণে ব্রতী হন। সবটুকুই করেন সংক্ষেপে, সহজ-সরল ভাষায় এবং নিজস্ব স্টাইলে। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার মনোবিশ্লেষণমূলক বই ‘মন ও মানসিকতা’। পরিবার, প্রেম, বন্ধুত্ব, কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যের অনুভূতি বুঝতে, নিজেকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে এবং নিজেকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করতে পারে বইটি।

মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের যেমন গৌরবময় অধ্যায়, তেমনি শ্রেষ্ঠতম অর্জন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হঠাৎ করেই হয়নি। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ। রয়েছে অসংখ্য অজানা গল্প। এসব গল্পকথা স্বাধীনতা লাভের পর থেকে অনেকেই তাদের রচনায় তুলে এনেছেন। আজও এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, করছেন অনেকেই। এই অনেকের মধ্যে সালেক খোকন একজন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃত ইতিহাস তুলে আনার প্রয়াসে কাজ করছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। তার নিরলস প্রচেষ্টায় আমাদের গৌরব ও বেদনার মহান মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত মানুষের কথা শোনাতে ব্রতী হয়েছেন, যারা ছিলেন অন্তরালে। কথাপ্রকাশ থেকে এবার মেলায় এসেছে সালেক খোকন রচিত ‘১৯৭১ : খেতাবপ্রাপ্ত ত্রিশ বীর’ বইটি। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত ত্রিশজন বীরের যুদ্ধস্মৃতি, যুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল; সেই সঙ্গে শতাধিক আলোকচিত্রের এক বিশাল পরিসরে সাজানো হয়েছে বইটি। এ গ্রন্থে একাত্তরের একজন বীরউত্তম, পাঁচজন বীরবিক্রম ও চব্বিশজন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ অপারেশনগুলো সরল গদ্যে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম, শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের প্রত্যয় ও অন্য ভাবনাপুঞ্জও সুচারুভাবে বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে কথোপকথন, সরল গদ্যঢঙে লেখা রচনাগুলো থেকে একজন সত্যসন্ধানী স্কলারের মননচর্চার পরিচয় মিলবে। লেখাগুলোয় পাওয়া যাবে একটা পুরো জীবন; যে জীবন যোদ্ধার, স্বপ্নের, ক্লান্তি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও দর্শনের।

মেলায় প্রতিদিনই নতুন বই আসে। আসছে। আসবে শেষ দিন পর্যন্ত। কত ধরনের বই! তবে প্রকৃত বই-ই কেবল দিতে পারে অনাবিল সুখ।