ধনীদের বিলাসবহুল গাড়িতে র‌্যাংগসের বড় রাজস্ব ফাঁকি

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, চট্টগ্রাম ব্যুরো
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ধনীদের বিলাসবহুল গাড়িতে র‌্যাংগসের বড় রাজস্ব ফাঁকি

জাপানের মিৎসুবিশি মোটরসের বাংলাদেশে ডিলার র‌্যাংগস লিমিটেড। ২০২২ সালের অক্টোবরে মিৎসুবিশি অ্যাট্রাজ সেডান কার আমদানি করে র‌্যাংগস। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দাখিল করা বিল অব এন্ট্রিতে ১১৯৩ সিসির এ গাড়ির মূল্য ঘোষণায় ছিল ৭ লাখ ২৫ হাজার জাপানি ইয়েন (৫ লাখ টাকার বেশি)। কিন্তু সেই গাড়ি শুল্কায়ন হয়েছে ১৮ লাখ ৪ হাজার ৮৩৪ ইয়েনে (১৩ লাখ টাকার বেশি)। ওই একটি চালানেই ৩২ লাখ ৩৯ হাজার ইয়েন কম মূল্য দেখানো হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা মূল্য ২১ লাখ ৭৫ হাজার ইয়েনের পরিবর্তে ৫৪ লাখ ১৪ হাজার ৫০২ ইয়েনে শুল্কায়ন হয়েছে। চালানটিতে গাড়ির প্রকৃত মূল্যের মাত্র ৪০ শতাংশ দেখানো হয়েছে। এক চালানেই সরকারি রাজস্ব ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল ২২ প্রায় লাখ টাকা।

একই প্রতিষ্ঠান ওই একই সময়কালে জাপান থেকে ১৪৯৯ সিসির মিৎসুবিশি ইক্লিপস ক্রস জিপের আমদানি মূল্য ঘোষণা দেয় ১৫ লাখ ইয়েন। ইন্টারনেটে গাড়িটির মূল্য যাচাই করে ২৮ লাখ ৫৯ হাজার ৫১৬ ইয়েন ধার্য করে শুল্কায়ন হয়। এতে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ৯০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। র‌্যাংগস এভাবেই বছরের পর বছর বেশি দামের গাড়ি কম মূল্য দেখিয়ে আমদানি করেছে। বাজারে কিন্তু সেই গাড়ি বিক্রি হয়েছে বেশি দামেই। কম মূল্য দেখিয়ে একদিকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। অন্যদিকে এর মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন শুল্ক কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, ব্র্যান্ড নিউ বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ঘোষিত মূল্যের ওপর শুল্কায়ন করছে কাস্টমস হাউসগুলো। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর জারিকৃত আদেশ মানা হচ্ছে না। অর্থাৎ সঠিক প্রক্রিয়ায় মূল্য যাচাই হচ্ছে না। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গাড়ি সরবরাহ করছে র‌্যাংগস লিমিটেড, র‌্যানকন ব্রিটিশ মোটরস লিমিটেড ও র‌্যানকন মোটরস লিমিটেড। তিনটি প্রতিষ্ঠান আমেরিকা, জার্মান, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বিলাসবহুল দামি গাড়ি আমদানি করে থাকে। আমদানিকৃত গাড়ির মধ্যে রয়েছে- মার্সিডিস বেঞ্জ, এমজি এমসিই জেডএস, মিৎসুবিসি ইক্লিপস ক্রস জিপ, মিৎসুবিসি এক্সপান্ডার ক্রস এসইউভি, মিৎসুবিসি অ্যাট্রাজ সেডান কার প্রভৃতি। এসব গাড়ি দেশের ধনী ব্যক্তিরাই সাধারণত ব্যবহার করেন। ক্রেতারা বেশি দামে গাড়ি কিনলেও কম মূল্য দেখিয়ে গাড়িগুলো দেশে আনা হচ্ছে। আন্ডার ইনভয়েসে শুল্কায়নে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

এক ঢিলে দুই পাখি: আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে শুল্ক ফাঁকির পাশাপাশি অর্থপাচার

সূত্র জানায়, কিছু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং করছে এমন তথ্য পায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এতে একদিকে দাম কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে অন্যদিকে টাকা পাচার হচ্ছে। শুল্ককর ফাঁকি রোধে ২০২০ সালে জারি করা এনবিআরের আদেশ মানছে না আমদানিকারক ও কাস্টমস হাউসগুলো। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ২০২৩ সালের এপ্রিলে একটি কমিটি গঠন করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ছয় সদস্যের কমিটি বিগত এক বছরে চট্টগ্রাম, মোংলা ও ঢাকা আইসিটি কাস্টমস দিয়ে আমদানি হওয়া গাড়ির তথ্য পর্যালোচনা করে। এতে বেশি দামের গাড়ি কম মূল্য ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ৪৪ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। গত ২৬ নভেম্বর প্রতিবেদনটি এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠান শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক।

চারটি বিষয় বিবেচনায় কমিটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেগুলো হলো- এনবিআর ২০২০ সালের আদেশ মেনে বিলাসবহুল গাড়ি শুল্কায়ন হয়েছে কিনা, না হলে কারণ অনুসন্ধান; আদেশে অস্পষ্টতা থাকলে তা চিন্তিতকরণ ও শুল্ককর ফাঁকি হলে আইনি ব্যবস্থার সুপারিশ। প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম, মোংলা ও কমলাপুর আইসিডি কাস্টমস দিয়ে আমদানিকৃত গাড়ির ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো পৃথকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের মাধ্যমে ৪ জন ডিলার ও ৯ জন বাণিজ্যিক আমদানিকারক, মোংলা দিয়ে ৪ জন ডিলার ও একজন বাণিজ্যিক আমদানিকারক এবং ঢাকা আইসিডি দিয়ে ৪ জন ডিলার গাড়ি আমদানি করেছে। এতে ৬১টি কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসে র‌্যাংগস লিমিটেডের ৫টি, মোংলায় র‌্যাংগসের একটি, র‌্যানকন ব্রিটিশ মোটরস লিমিটেড ৩টি এবং ঢাকা আইসিডি দিয়ে র‌্যানকন মোটর লিমিটেডের ৬টি নথির পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। পর্যালোচনা শেষে শুল্ক ফাঁকি বন্ধে কমিটি ছয় দফা সুপারিশ করে।

তদন্ত কমিটির পর্যালোচনা:

তদন্ত কমিটির সদস্যদের ভাষ্য মতে, ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি শুল্কায়নে এভি (গড় মূল্য) নির্ধারণে এনবিআরের আদেশ রয়েছে। বিগত সময়ে মূল্য নির্ধারণে আদেশের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পরিপালন না করেই ডেটাবেজ মূল্য নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস ও ঢাকা আইসিডিতে কন্টেইনারবাহিত একটি গাড়ির ফ্রেইট চার্জ দেখানো হতো ৩০০-৫০০ ইউএস ডলার; যেখানে ফ্রেইট চার্জ ছিল ২৫০০-৩০০০ ডলার। বর্তমানে কমপক্ষে ২০০০ ডলার নির্ধারণ হচ্ছে। জাপান ছাড়া অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকৃত গাড়ির ম্যানুফেকচারার ইনভয়েস না থাকলে প্রকৃত মূল্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে গ্লাস গাইড, ওয়েবসাইট ভ্যালু না থাকলে বাজারমূল্যের ভিত্তিতে শুল্কায়ন যৌক্তিক ছিল। গাড়ি প্রস্তুতকারক দেশের বাংলাদেশস্থ দূতাবাসের মাধ্যমে মূল্য যাচাইয়ের কথা থাকলেও আইসিডি হতে পত্র দেওয়া হয়েছে ঢাকার বিদেশি দূতাবাসে, যাতে প্রকৃত মূল্য তথ্য পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ওয়েবসাইট/বাজারমূল্যের ভিত্তিতে এভি নির্ধারণ করায় কোনো কোনো গাড়িতে রাজস্ব আদায় হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে সকল স্টেশনে মূল্য নির্ধারণে যৌক্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা যাবে। গাড়ির শুল্কায়নে দক্ষ কর্মকর্তা পদায়নও জরুরি। কারণ অনেক সময় আমদানিকারক গাড়ির মডেলও সঠিক ঘোষণা দেয় না।

অর্ধেক দাম ঘোষণা মিৎসুবিসি এক্সপান্ডার সেডান কারে:

বাংলাদেশে মিৎসুবিসির ডিলার র‌্যাংগস লিমিটেড ১৪৯৯ সিসির মিৎসুবিসির এক্সপান্ডার ক্রস এসইউভি আমদানি করে। ২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খালাস নিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে দািখল করা বিল অব এন্ট্রিতে এ গাড়িটির মূল্য ঘোষণা দেওয়া হয় ১৪ লাখ ২৮ হাজার জাপানি ইয়েন। অথচ সেটি শুল্কায়ন হয়েছে ২৪ লাখ ৪৩ লাখ ৯১ ইয়েন। এতে সরকারের রাজস্ব বেড়েছে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ। একইভাবে মিৎসুবিসি এক্সপান্ডার সেডান কারও প্রকৃত মূল্যের অর্ধেক মূল্যে আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দামি গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে একেবারেই কম মূল্য ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই দামে ক্রেতাদের কাছে গাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে না। কখনো কখনো গাড়ির সিসি, ভুল মডেল নাম্বারে শুল্কায়ন করানো হচ্ছে। এ ছাড়া তৃতীয় দেশ থেকে আমদানির যে প্রক্রিয়া, সেখানেও গলদ রয়েছে। জাপানের মিৎসুবিসি গাড়ি থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করছে র‌্যাংগস। সেক্ষেত্রে ম্যানুফেকচারার ইনভয়েস দাখিল এবং মাদার কোম্পানির নামেই এলসি হওয়ার কথা। দেখা যাচ্ছে তৃতীয় কোনো দেশের নামে এলসি হচ্ছে। মিৎসুবিসির গাড়ি ডিলার হিসাবে আসছে নাকি সেখানকার কোনো ডিলারের মাধ্যমে আমদানি হচ্ছে- বিষয়গুলো স্পষ্ট নয়।

বিলাসবহুল গাড়ি শুল্কায়নের ক্ষেত্রে এনবিআরের আদেশ পরিপালন হলে ডিলার ইচ্ছেমতো মূল্য ঘোষণা দিতে পারত না। এক্ষেত্রে ম্যানুফেকচারার ইনভয়েস ও নিজেদের মূল্য ঘোষণা ফরম দিচ্ছে না; মানা হচ্ছে না শুল্কায়ন বিধি।

চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারের বক্তব্য:

আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফায়জুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, মূল ম্যানুফেকচারার তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে গাড়ি রপ্তানি করে না। তৃতীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি হয়; ফলে ম্যানুফেকচারার ইনভয়েস পাওয়া যায় না। আবার এটার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না; কারণ দূতাবাসে তথ্য চাইলে কমার্শিয়াল ইনভয়েস সঠিক বলে জানায়। ম্যানুফেকচারার ইনভয়েস বাধ্যতামূলক করলেই এটা বন্ধ করা যাবে। তবে বিষয়টি সঠিক নয় বলে মনে করেন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা বলেন, তথ্য যাচাইয়ে রপ্তানিকারক দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি দিতে; কিন্তু দেওয়া হয় বাংলাদেশে অবস্থিত রপ্তানিকারক দেশের দূতাবাসে। এ ছাড়া গ্লাস গাইডের পাসওয়ার্ড নিয়েও শুল্কায়ন করা সম্ভব। সেখানে প্রতিবছর উৎপাদনকারী সকল দেশের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির তথ্য দেওয়া থাকে।

বারবিডা সভাপতির বক্তব্য:

বিলাসবহুল নতুন গাড়ির আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে স্বীকার করে বারবিডা সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন বলেন, রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিতে ইয়েলো বুক দেখে শুল্কায়ন হয়। নতুন গাড়ির শুল্কায়ন সহজীকরণ করা উচিত। এক্ষেত্রে গ্লাস গাইড বুক অনুসরণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। তাহলে আর চুরি করার সুযোগ থাকবে না।