উত্তরাঞ্চলের সড়কে চাঁদাবাজির মচ্ছব
রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে পণ্যবাহী পরিবহনে চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। এসব চাঁদাবাজি হচ্ছে মূলত শ্রমিক ইউনিয়নের নামে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়েও চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে। চাঁদা না দিলে অনেক চালককে মারধরও করা হয়। কিছু নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে চাঁদাবাজির প্রভাব রয়েছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
এদিকে চাঁদাবাজি বন্ধে মাঠে নেমেছে র্যাব। উত্তরের কয়েকটি জেলায় চলছে বিশেষ অভিযান। এরই মধ্যে চাঁদাবাজির অভিযোগে অন্তত ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।
রাজশাহী মহানগরীর সবচেয়ে বড় সবজির হাট খড়খড়ি। ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। এখান থেকে শাকসবজি যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এ হাট থেকে প্রায়ই বিভিন্ন জেলায় পণ্য নিয়ে যান ট্রাকচালক রুস্তম আলী। তিনি অভিযোগ করেন, বাঘা, চারঘাট, খড়খড়ি বাইপাসসহ ঢাকা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন মোড়ে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হয়। সিøপে যদি ৪০ টাকা লেখা থাকে, আদায় করা হয় ৪০০ টাকা। এভাবে ঢাকা পর্যন্ত যেতে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।
বাগমারা উপজেলার ট্রাকচালক হেদায়েত উল্লাহ বলেন, ‘চাঁদা না দিলে আমাদের গাড়ি আটকে রাখা হয়। সার্জেন্টকে দিয়ে মামলার ভয়ও দেখান চাঁদাবাজরা। এই টাকা মহাজনরা ঠিকই পণ্যের দামে যুক্ত করেন।’
ট্রাকচালকদের অভিযোগ, ‘আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন’, ‘জেলা ট্রাক ট্যাংক লরি, কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি’ ও ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের’ রাজশাহী
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির নামে চাঁদা আদায় করা হয়। এর মধ্যে দিনে ট্রাকপ্রতি ৭০ টাকা, আর রাতে নেওয়া হয় ১০০ টাকা। তিন সংগঠনের সদস্যদের কল্যাণের নামে এই চাঁদা তোলা হলেও বেশির ভাগ সময়েই কোনো রসিদ দেওয়া হয় না।
বগুড়া হয়ে প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালনশাহ সেতু হয়ে সারাদেশে ১৫ হাজার পণ্যবাহী যান চলাচল করে। প্রতিটি যান থেকে ৭০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সেই হিসাবে প্রতিমাসে বগুড়ায় চাঁদাবাজি হয় তিন কোটি টাকা। এই টাকার একটা বড় অংশ পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের পকেটে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদরুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কে শ্রমিকদের চাঁদাবাজিতে আমরা অতিষ্ঠ। শ্রমিক নেতাদের বারবার বলেও কাজ হয় না। বাধ্য হয়ে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ করেছি। কারণ এর প্রভাব গিয়ে বাজারে পড়ছে। এই চাঁদাবাজিতে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাই জড়িত।’
র্যাবের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে রাজশাহী, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরের বিভিন্ন সড়ক ও ট্রাক টার্মিনালে অভিযান চালিয়ে রশিদ বই, নগদ অর্থ, লাল ঝা-া ও লাঠিসহ অন্তত ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজশাহী জেলা ট্রাক, ট্যাংক-লরি ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, ‘র্যাবের অভিযানের কারণে আপাতত চাঁদা তোলা বন্ধ রয়েছে। আমাদের ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এখন দেখি তারা কী সিদ্ধান্ত নেন।’
র্যাব জানায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর তানোর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সড়কে চাঁদাবাজির সময় চারজনকে আটক করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা সড়কে গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। একই দিন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বঙ্গবন্ধু মোড়ে চাঁদাবাজি চক্রের মূল হোতা আরমান রানাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর দুদিন আগে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় নাটোরে। একই দিন জয়পুরহাট জেলার কলাবাজার এলাকায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী নগরীর শাহ মখদুম ট্রাক টার্মিনালে গ্রেপ্তার করা হয় চারজনকে। একই দিন নগরীর কাটাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ গতকাল রাজশাহী নগরীর রেলগেট থেকে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চাঁদাবাজি চলে যাত্রীবাহী বাসেও। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার সড়কের মোড়ে মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চাঁদা তোলেন শ্রমিকরাই। এ নিয়ে বাসমালিক ও শ্রমিকদের মাঝেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে বাস আটকে চাঁদাবাজির প্রতিবাদে গত ১৮ জানুয়ারি রাজশাহী-রংপুর রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজশাহী বিভাগীয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলামের অভিযোগ, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে স্থানীয় মালিক সমিতির নামে কুড়িগ্রাম থেকে আসা বাসগুলো থেকে চাঁদাবাজি হয়।
রাজশাহী সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মতিউল ইসলাম টিটো বলেন, ‘আমরা মালিকরাও সড়কে চাঁদাবাজির বিপক্ষে। পরিবহনসংক্রান্ত যে কোনো সভা-সমিতিতে আমরা এর বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিচ্ছি। র্যাবের যে অভিযান চলছে, তাকেও আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির কারণে কিছু নিরীহ শ্রমিকও নাজেহাল হচ্ছে।’
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর যৌথ সিদ্ধান্তেই সংগঠনের কল্যাণ ব্যয় মেটাতে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এটা অবৈধ নয়। আমাদের পরিবহন থেকে আমাদের শ্রমিকরাই টাকা তোলে; এটি নতুন ঘটনা নয়। আর রসিদ ছাড়া টাকা আদায়ের অভিযোগ সত্য নয়।’
রাজশাহী র্যাব ৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে চাই। এ জন্য বিশেষ অভিযান চলছে। এরই মধ্যে গত এক সপ্তাহে প্রায় ৫৬ জনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
র্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘চাঁদাবাজির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হচ্ছে। রাজনীতিক ও বিভিন্ন সংগঠনের নামে তারা চাঁদাবাজি করেন। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা ৬০ টাকা আদায় করেন। এই অর্থ আদায়েরও কোনো ভিত্তি নেই। আমরা দেখছি পণ্যবোঝাই ট্রাক থেকে ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা আদায় করা হয়। এমনকি বিভিন্ন জায়গায় ইজারা দেওয়ার নামে সব পরিবহন থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। সড়কে কোনো ধরনের অবৈধ চাঁদাবাজি চলতে দেওয়া হবে না।’