সংক্রমণ মারাত্মক হলেও প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল
যক্ষ্মায় আক্রান্ত মোহাম্মদ আলী সমানে কেশে চলেছেন। পাশেই বসা তার সহধর্মিণী ও চাচাতো ভাই। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, মুখে নেই মাস্ক। অন্তত তিন ফুট দূরত্বে থাকার কথা থাকলেও খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছু হচ্ছে এক শয্যায় বসে। এতে করে যে মারাত্মক সংক্রমণ ছড়াচ্ছে সে ব্যাপারে ধারণাও নেই তাদের। গত দশ দিন ধরে রাজধানীর জাতীয় বক্ষ্যবাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই রোগী।
রোগীর পাশাপাশি সংক্রমণ প্রতিরোধে উদাসীন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। মাস্ক পরাসহ রোগীর সঙ্গে থাকার ব্যাপারে কঠোরতার পাশাপাশি নেই প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ডেডিকেটেড টিম কিংবা কমিটি।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. খায়রুল আনাম বলেন, সরকারি হাসপাতালের সবচেয়ে বড় সমস্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী ও জনবল ঘাটতি। আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনে এখানে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী নেই। ফলে চাইলেও অনেক কিছু সম্ভব নয়। সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হলে সবার আগে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু এ হাসপাতালে নয়। অতিমারী করোনাকালে দেশের সরকারি সব হাসপাতালে ইনফেকশন (সংক্রমণ), প্রিভেনশন (প্রতিরোধ) অ্যান্ড কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) বা আইপিসি ব্যবস্থায় জোর
দেওয়া হলেও মহামারী চলে যাওয়ার পরপরই আবারও আগের মতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে হাসপাতালে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ। ৭২ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে আইপিসি কার্যক্রম থাকলেও কার্যকর নয় ৬০ শতাংশের। এতে করে সংক্রমণজনিত মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
সরকারি হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধে এমন দুর্বল ব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে এসেছে স্বয়ং সরকারি গবেষণায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে সব সময়ই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী, সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকাসহ নানা কারণে সংক্রমণজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। করোনাকালে সরকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলেও পরিস্থিতি শিথিল হলে আবারও গা-ছাড়া ভাব তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
দেশের হাসপাতালগুলোতে পুরোপুরি আইপিসি আছে কিনা ও কমিটি কতটা কার্যকর সেটি দেখতে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল একটি গবেষণা করেছে। সরকারি টারশিয়ারি ১১টি, বিশেষায়িত ১১টি, বেসরকারি হাসপাতাল ১১টি, বেসরকারি করপোরেট ৪টিসহ সারাদেশের ৩৭টি হাসপাতালে এ গবেষণা করা হয়।
“টারশিয়ারি কেয়ার হাসপাতালের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের মানদ-ের বেসলাইন মূল্যায়ন”- শিরোনামের এই গবেষণা করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৪৬ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে সংক্রমণ ও জীবাণুমুক্ত করতে কোনো ধরনের নীতিমালা নেই। ৫১ শতাংশের বেশি হাসপাতালে থাকলেও ব্যবস্থাপনায় দুর্বল। পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের নীতিমালা রয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ হাসপাতালে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি টারশিয়ারি হাসপাতালের ১১টির মধ্যে মাত্র একটিতে ফুলটাইম ডেডিকেটেড সংক্রমণ প্রতিরোধী টিমের কার্যক্রম চালু রয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালে একটিও নেই। ৭২ সরকারি হাসপাতালে কমিটি থাকলেও তা অনেকটা অকার্যকর।
উদ্বেগের বিষয় হলো- সংক্রমণ প্রতিরোধে কাজ করা সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে মাত্র ৪৬ শতাংশের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নীতিমালা থাকলেও ৫৫ শতাংশই দুর্বল ব্যবস্থাপনায় চলছে।
গবেষক দলের প্রধান মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মনজুরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের বড় অংশ চিকিৎসা নেয় সরকারি হাসপাতালে। সংক্রমণ প্রতিরোধে বেসরকারি হাসপাতালগুলো কিছুটা এগিয়ে থাকলেও অত্যন্ত নাজুক অবস্থা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। করোনার সময়ে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হলেও বর্তমানে উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। আমাদের সেবাপ্রদানকারীদের প্রশিক্ষণে বড় ঘাটতি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ হাসপাতালে কমিটি থাকলেও সভা ও কার্যক্রম ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তার তদারকি নেই। আবার কেউ সংক্রমিত হলেও কী ধরনের জীবাণু ধরা হচ্ছে তার শনাক্তে জোরালো কোনো ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। আইপিসি না মানলে হাসপাতাল থেকে রোগীদের মধ্যে যে ধরনের ইনফেকশন হয়ে থাকে, সেটি মারাত্মক আকারে বেড়ে যাবে। এসব জীবাণুর অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। কাজেই আক্রান্ত হলেই মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে।’
২২ জানুয়ারি রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালে সিজারের মাধ্যমে ছেলেসন্তান জন্ম দেন হাসনা আক্তার। প্রসবের দু-একদিন পর বাড়িতে ফিরলেও সপ্তাহ পেরোতেই আবারও হাসপাতালে আসতে হয়েছে তাকে। কারণ হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ব্যাকটেরিয়ার শিকার হয়েছেন তিনি।
গাইনি ও প্রসূতি ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স স্মৃতি ও ফরিদাসহ কয়েকজন নার্স জানান, তাদের সকাল শুরু হয় এসব সংক্রমণের বিষয় মাথায় নিয়ে। রোগীদের মধ্যে অসচেতনতা অনেক বেশি। ব্যবস্থাপনায়ও দুর্বলতা রয়েছে বলে জানান তারা।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সংক্রমণ প্রতিরোধে ৭ সদস্যের একটি কমিটি আছে। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু সব সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। কারণ ৫শ থেকে সাড়ে ১৩শ শয্যার হাসপাতাল হলেও সে অনুযায়ী জনবল বাড়েনি। ৫শ জনের জন্য জনবল দিয়ে দুই থেকে ৩ গুণ বেশি রোগীর সেবা এবং হাসপাতালকে পরিষ্কার রাখা অনেকটা অসম্ভব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালে করোনা মহামারী শুরু হলে হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে সময় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও গুরুত্বহীন হয়ে ওঠে বিষয়টি।
তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিত্র ব্যতিক্রম। ২০২০ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আদেশ অনুযায়ী হাসপাতালের পরিচালককে সভাপতি করে আইপিসি কমিটি গঠন করার পাশাপাশি কার্যক্রম আরও সফল করার উদ্দেশ্যে একটি ৩০ সদস্যের আইপিসি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে যেখানে পাঁচ সদস্যের একটি ডেডিকেটেড আইপিসি নার্স টিমও করা হয়। যা এখন দশ সদস্যে রূপ নিয়েছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী থাকায় চলতি বছর ৪২ সদস্যের আইপিসি উপকমিটি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এই কমিটির সদস্য সচিব প্রতিষ্ঠানটির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘আইপিসি নিয়ে কাজ করতে করোনার শুরু থেকে আমাদের পদক্ষেপ চলে এসেছে। কমিটি বিভিন্ন ওয়ার্ডে ইনফেকশন রেট দেখেও ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বর্তমানেও নিয়মিত সভা হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘মূলত করোনা মহামারীকে ঘিরে ওই সময়ে আইপিসি ম্যানেজমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। পরে এটাকে অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি আছে, হয়তো একটু শিথিলতা রয়েছে। এগুলো সক্রিয় থাকা দরকার। কমিটিতে আলাদা লোকবল দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই বিদ্যামান ব্যবস্থা দিয়েই এটি চালিয়ে যেতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবুল জামিল ফয়সাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সর্বাগ্রে রোগীরা যেখানে যায় অর্থাৎ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেই সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। গোড়া থেকে কাজ করা গেলে টারশিয়ারি কিংবা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে এসব বিষয় মেনে চলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। নয়তো কমিটি করেও ইতিবাচক ফল মিলবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে শিক্ষা কার্যক্রমে হেলথ অ্যান্ড হাইজেন বিষয়টিকে বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি নীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।’