বিশ্বজুড়ে বইয়ের যত গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিশ্বজুড়ে বইয়ের যত গল্প

ফুলের বিনিময়ে বই

১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রসিদ্ধ ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিকে প্রকাশিত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, বইমেলার সময় সেখানকার রেওয়াজ অনুযায়ী পুরুষরা তাদের প্রেমিকা, বান্ধবী, স্ত্রী অথবা যে কোনো নারী আত্মীয়র হাতে ফুল তুলে দেন এবং বিনিময়ে নারীরা বইমেলা থেকে তাদের বই উপহার দেন। তিনি সাংবাদিকের বই আর ফুলের সম্পৃক্ততা জানার চেষ্টা করলে মার্কেস স্ত্রীর হাতে থাকা গোলাপটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তিনি আরও বলেন, আমরা কাঠের তৈরি বইয়ের স্টলগুলোর মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলাম! আর লক্ষ করছিলাম বইয়ের স্টলের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে অজস্র ফুলের ছড়াছড়ি।

বইমেলার সঙ্গে মিশে আছে নানান দেশের সংস্কৃতি

বইমেলার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতি, প্রথা ও মিথের সম্পৃক্ততা হয়ে গেছে। যেমন স্পেনের বার্সেলোনায় বইমেলাকে সেখানকার লোকজন গোলাপের দিন, প্রেমিকের দিন, সেন্ট জর্জের উৎসব ও আরও বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করে থাকে। সেন্ট জর্জকে নিয়ে স্পেনের ট্যারাগোনায় একটা মিথ বেশ জনপ্রিয়। লোকমুখে জানা যায়, একটি ড্রাগন ট্যারাগোনার মন্টব্যাঙ্ক রাজ্যে আক্রমণ চালিয়েছিল। ড্রাগনের হাত থেকে রক্ষা পেতে স্থানীয় বাসিন্দারা সে ড্রাগনকে প্রতিদিন দুটি করে ভেড়ার বাচ্চা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ড্রাগনের ক্ষুধা নিবৃত্ত হয় এবং শহর ও শহরের লোকজন নিরাপদ থাকে। এভাবে দিনের পর দিন পশু সরবরাহ করতে গিয়ে এক সময় পশু পাওয়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। তখন শহরের কর্তাব্যক্তিদের আলোচনা অনুযায়ী প্রতিদিন লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত একজন লোক ও একটি মেষশাবক ড্রাগনের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যে পরিবারের সদস্য ড্রাগন দ্বারা ক্ষতির শিকার হবে তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধনসম্পদ।

বিশ্বের প্রথম বইমেলা

আমাদের দেশে বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো না হলেও বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপিত বইমেলার ইতিহাস পাঁচশ বছরের অধিক পুরনো। জানা যায়, ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে দ্বাদশ শতাব্দীতে জার্মানিতে হাতে লেখা বই বিক্রি হতো। পরে ১৪৬২ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টার মেসে বিশ্বের প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। যা ‘দ্য ফ্রাঙ্কফুর্ট বুকফেয়ার’ নামে পরিচিত। সে সময় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট ছিল ইউরোপের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষের যাতায়াত ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টে। তাদের কেন্দ্র করেই মূলত গড়ে উঠেছিল ফ্রাঙ্কফুর্টার মেস। বর্তমানে ‘দ্য ফ্রাঙ্কফুর্ট বুকফেয়ার’ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। এ মেলায় বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ থেকে ৭৩০০-এর মতো পুস্তক প্রকাশক ও পরিবেশক অংশ নিয়ে থাকেন। মেলাটি মুখ্যত তিন ভাগে বিভক্ত থাকেÑ (ক) নিজেদের প্রকাশনা নিয়ে উপস্থিত থাকেন যারা তাদের জন্য, (খ) মেলায় আসা পাঠক-ক্রেতাদের জন্য, (গ) ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া বিজনেস সেন্টার। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘গেস্ট অব অনার’ বা সাম্মানিক অতিথি হিসেবে কোনো এক নির্দিষ্ট দেশের উপস্থিতি। এই বইমেলায় ‘গেস্ট অব অনার’ হওয়াকে প্রতিটি দেশই অত্যন্ত সম্মানজনক মনে করে এবং এর জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিযোগিতাও থাকে। গত কয়েক বছরে ফ্রান্স, জর্জিয়া, নরওয়ে, কানাডা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ‘গেস্ট অব অনার’ হয়েছে।

বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ৫ বইমেলা

বুক এক্সপো আমেরিকা

১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘আমেরিকান বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘কনভেনশন এবং ট্রেড শো’ নামে শুরু হয় বই নিয়ে এই আয়োজনের। ১৯৭১ সালে নাম বদলে ‘বুক এক্সপো আমেরিকা’ নাম রাখা হয়। মে মাসের শেষে বা জুন মাসের শুরুতে চার দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে পালাক্রমে চলত এ বইমেলা। ২০০৮-এ লস অ্যাঞ্জেলেসে, নিউইয়র্ক সিটিতে ২০০৯-১৫ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে শিকাগোয় হয়েছে এ মেলা। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে বুক এক্সপো। ২০২০ সালেই আয়োজক সংস্থা ‘রিডপপ’ ঘোষণা করেছিল ‘বুক-এক্সপো’ ও সাম্প্রতিক সময়ে তার সঙ্গে শুরু হওয়া জনপ্রিয় দুটি ইভেন্ট ‘দ্য বুককন’ ও ‘আনবাউন্ড’ আপাতত ‘অবসর’ নিচ্ছে। ২০২২-এর মে মাসে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয় ‘ইউএস বুক শো’, যা ২০২১ সালে শুরু করেছিল পাবলিশার্স উইকলি ‘বুক এক্সপো’র বিকল্প হিসেবে। তবে অদূর ভবিষ্যতে ‘অবসর’ ভেঙে ‘বুক এক্সপো’র ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে না।

লন্ডন বইমেলা

লন্ডন বইমেলার নাম শোনেনি, এমন বইপ্রেমী বিশ্বে খুঁজে পওয়া মুশকিল। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলার একটি। তবে আয়তনের দিক থেকে এই মেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার মতো বড় নয়। প্রতিবছর মার্চ মাসে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ১৯৭৬ সাল থেকে লন্ডন বইমেলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে কখনো কখনো বিশেষ পরিস্থিতির কারণে মেলার তারিখ ও স্থান পরিবর্তন হয়। এ রকম ঘটেছিল ২০০৬ সালে। ওই বছর মেলাটি হয়েছিল লন্ডনের অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে। পরের বছর আবার মেলাটি হয়েছিল ডকল্যান্ডের আর্ল কোট এক্সিবিশন সেন্টারে। লন্ডন বইমেলার মেয়াদ ১২ দিন। তবে আয়োজনের প্রথম দিকে এর মেয়াদ ছিল সাত দিন। জনপ্রিয়তার কারণে পরবর্তী সময়ে মেলার মেয়াদ বাড়ানো হয়।

বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা

বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা পৃথিবীর বৃহত্তম বইমেলাগুলোর একটি। আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্স এর প্রতিষ্ঠিত ‘ফান্দাসিঁও এল লিব্রো’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা এই বইমেলার আয়োজন করে থাকে। লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, অনুবাদক, বিক্রেতা এবং প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতদের অংশগ্রহণে কনফারেন্স ও সভা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে বুয়েন্স আয়ার্সে ৩৫টিরও বেশি বইমেলা আয়োজিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ‘আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্স’ আর্জেন্টিনার সম্পাদনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এই বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৫ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাড়ে সাত হাজার বর্গমিটার জায়গা নিয়ে অনুষ্ঠিত সেবারের মেলায় ৫০ জন লেখক এবং আর্জেন্টিনার বাইরের আরও ৭টি দেশ অংশ নেয়। প্রথমবারেই বইমেলায় দর্শনার্থী হয়েছিল প্রায় দেড় লাখ। এখন এই মেলার আয়োজন হয় আর্জেন্টাইন রুরাল সোসাইটির ৪৫ হাজার বর্গমিটার এলাকা নিয়ে। অন্তত ৫০টি দেশের অংশগ্রহণে এই মেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখে। প্রতিবছর এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হওয়া এই মেলা চলে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত।

কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা

কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা হলো এশিয়ার সবচেয়ে বড় বইমেলা। ঠিক আমাদের মতোই ওখানেও এই বইমেলা গণ্য হয় উৎসব হিসেবে। কলকাতার একেবারে নিয়মিত জীবনযাপনের অংশ হিসেবে। আমাদের মতোই বই কিনি আর না-ই কিনি প্রতিদিন বইমেলায় যাওয়া চাই, এমন অসংখ্য মানুষ সেখানে আছেন। আর এ কারণেই বইপ্রেমীদের বৃহত্তম সম্মিলনী হিসেবে কলকাতার বইমেলাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘অবাণিজ্যিক’ বইমেলা। বইমেলায় আগত মানুষের হিসেবে তো নিশ্চিতভাবেই এটি বলা যায়, কারণ এখন প্রায় ২৫ লাখ মানুষের সমাগম হয় এখানে। ১৯৭৬ সালে একেবারে ছোট পরিসরে ‘কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ নামের একটি সংস্থার আয়োজনে এই বইমেলার প্রথম আয়োজন হয়েছিল। বইয়ের দোকানের স্বল্পতার বিপরীতে মানুষের বই কেনার আগ্রহের কথা বিবেচনা করেই শুরু হয়েছিল এই মেলা। কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে ১৯৯২-এর আগ পর্যন্ত দুটো পৃথক বইমেলা হতো কলকাতায়। সে বছর থেকেই দুটি মেলাকে একীভূত করে ফেলা হয়।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত এ মেলা শিশু গ্রন্থমেলা নামে পরিচিতি পেয়েছিল। কথাসাহিত্যিক, গল্পকার ও সম্পাদক সরদার জয়েন উদদীন এ বইমেলার আয়োজন করেছিলেন। সে সময় তিনি বাংলা একাডেমির সহকারী প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে দ্বিতীয়বারের মতো এ বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরও আয়োজক ছিলেন সরদার জয়েন উদদীন। ১৯৭২ সালে ইউনেস্কো গ্রন্থবর্ষ ঘোষণা করলে চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। এ অনানুষ্ঠানিক বইমেলা ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত চলমান থাকে। ১৯৮৪ সালে এসে এ বইমেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে অলংকৃত হয়। ধীরে ধীরে বইমেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অনেক আয়োজন। ক্রমান্বয়ে মেলার পরিধি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে জনসমাগম। প্রতিবছর ছাপা হতে থাকে লাখ লাখ বই। প্রথমে মেলার বি¯ৃÍতি বাংলা একাডেমির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে তা বিস্তৃতি লাভ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। মেলা উপলক্ষে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আয়োজন করা হয় আবৃত্তি, লেখক আড্ডা ও আলোচনাসভা।

মিশরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা

১৯৬৯ সালে কায়রো শহর প্রতিষ্ঠার ১ হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে আরব বিশ্বের প্রাচীন এই আন্তর্জাতিক বইমেলার শুরু হয়। কালক্রমে এর পরিধি ও সমৃদ্ধি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বর্তমানে কোনো কোনো সমীক্ষায় একে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা। আরব বিশ্বের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম বইমেলা হলো কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই এই মেলার আয়োজন করে ‘জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অরগানাইজেশন’। আরবীয় প্রকাশনার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই বইমেলাকে। প্রতিবছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মিশরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় কায়রোর বইমেলা।