যান-যন্ত্রণার জাঁতাকলে পিষ্ট রাজধানীবাসী

তাওহীদুল ইসলাম
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
যান-যন্ত্রণার জাঁতাকলে পিষ্ট রাজধানীবাসী

রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থা লেজেগোবরে দশা। ভাড়া, সেবা, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, নিরাপত্তা- এসবের কিছুই নেই। ঢাকার আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা। বাস্তবে রয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ছোট, ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে প্রয়োজন গণপরিবহন বাড়ানো। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। কমছে বাস-মিনিবাস; বাড়ছে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল। বেসরকারি বাস-মিনিবাসে চলাচল দুষ্কর নিম্নমানের সেবার কারণে। বিআরটিসির বাসও যাত্রীর তুলনায় অত্যল্প, তাও অনেক রুটেই নেই। উপরন্তু রয়েছে যানজটের হ্যাপা। সিএনজি অটোরিকশার মিটারে না চলার অভিযোগ পুরনো। রাইডশেয়ারিং সেবাও যতদিন যাচ্ছে, ততই মানহীন হয়ে পড়ছে। বেশি অভিযোগ আসে রাইড রিকোয়েস্ট পাওয়ার পর। গন্তব্য পছন্দ না হলে রিকোয়েস্ট ক্যানসেল করে দেন চালকরা। আবার চুক্তিতে মোটরসাইকেল-প্রাইভেটকারে চলাচলও নিরাপদ নয়। সব মিলিয়ে যান যন্ত্রণার জাঁতাকলে রীতিমতো পিষ্ট রাজধানীবাসী।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল সড়কপথ নয়। সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বয়ে গণপরিবহন হয়ে উঠতে পারে নগরবাসীর চলাচলের উপযুক্ত মাধ্যম। ঢাকার চারপাশে সড়ক, রেল ও নৌপথ চালুর প্রক্রিয়াও হতাশাজনক। ২০১৫ সালে অনুমোদিত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) মেট্রোরেল, বিআরটির মতো ঢাকাকে ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল- শহরের অভ্যন্তরে গাড়ির চাপ কমাতে নগরীর চারপাশ দিয়ে যান চলাচল করবে। কিন্তু অর্থাভাবে আটকে আছে রাজধানীর বৃত্তাকার পথ।

মেট্রোরেল চালুর ফলে কিছু দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে, সড়কের চাপ মেট্রোতে। তাই মানুষের আর দুর্ভোগ থাকবে না। কমবে যানজট। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হওয়া মেট্রোরেলে এ শহরের মোট যাত্রীর সামান্য অংশই চলাফেরা করছেন। এতে সড়কের চাপ কমছে না। উন্নত বিশে^ মেট্রোর পাশাপাশি বাস সার্ভিসও রয়েছে। যাত্রীরা তাদের সময়সূচি ও গন্তব্য বিবেচনায় পছন্দের বাহন বেছে নেন। কেবল ঢাকাতেই এর ব্যতিক্রম।

জানা গেছে, নগরীর যানজট নিরসনে নির্মাণ করা হচ্ছে ফ্লাইওভার। এতে করে গণপরিবহনে জোর না দিয়ে ছোট গাড়িকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিমানবন্দর

থেকে ফামর্গেট অংশ পর্যন্ত চালু হওয়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সেই বার্তা দিচ্ছে। এ উড়ালসড়কের র‌্যাম্পে ওঠানামার কারণে কিছু সড়কজুড়ে বাড়তি যানজট তৈরি হচ্ছে। বিআরটিসির কয়েকটি বাস ছাড়া বেশির ভাগ ব্যক্তিগত (ছোট) গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ২ কোটি ৮১ লাখ ২৬০টি। এর মধ্যে রাজধানীতে বাস ও মিনিবাসের রুট পারমিট রয়েছে ৪ হাজার ৪৪৮টি। একই রুটে একাধিক পরিবহনের বাস চলাচল করায় যাত্রী টানতে দেখা যায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বেসরকারি বাসের আসন-জানালার কাচ ভাঙা নিয়ে কথা বলার আগেই শুরু হয় ভাড়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা। যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহনকর্মীদের অসদাচরণ নিত্যঘটনা। তবে সড়কের ওপরে মেট্রোতে আছে শৃঙ্খলা। অবস্থা থেকে উত্তরণে সেবার মান বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপের উদ্যোগ নিয়েছেন বাসমালিকরা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেছেন, মেট্রোর কারণে বর্তমানে বাসের জ্বালানি খরচ উত্তোলন কঠিন হয়ে গেছে। তাই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেবার মান বাড়িয়ে যাত্রীদের কাছাকাছি যাওয়া নিয়ে।

পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোতে স্বল্প গন্তব্যের এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনের ভাড়া বেশি। ফার্মগেট স্টেশন থেকে উঠে কারওয়ানবাজারে নামলেও এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনের সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। অথচ বাসে এ দূরত্বের ভাড়া মাত্র ৫ টাকা। তাই সড়কের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এ জন্য যাত্রীসেবা উন্নত করা জরুরি। মেট্রোরেলে চড়া যাত্রীদের ৬০ শতাংশ সড়কের। এসব যাত্রী তাদের সময় ও সুবিধাভেদে সড়কে ফিরতে পারেন কাক্সিক্ষত সেবা পেলে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, কেবল সড়ক নয়। গণপরিবহন হতে হবে সমন্বিত। সড়ক, রেল ও নৌÑ সব দিকেই যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি সড়ক থেকে কমাতে পারলে বাস-মিনিবাস সার্ভিস গুরুত্ব পাবে।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে প্রায় ৬শ বিআরটিসির বাস চলাচল করে। এর মধ্যে নারীদের জন্য ৯টি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-অফিস ছাড়াও নানা সেবা রয়েছে। বাণিজ্যমেলা, উড়ালসড়কসহ সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে এ করপোরেশন সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে গত এক যুগে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। ঢাকা মহানগরীতে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ নানা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু খেয়াল কম গণপরিবহনের দিকে। ব্যক্তিগত গাড়িই নামছে বেশি। প্রতিদিন দেশের সড়কে নতুন করে নামছে ১ হাজার ৪০৯টি মোটরসাইকেল, ৫০টি প্রাইভেটকার আর ১০টি করে বাস। প্রাইভেটকারের আধিক্য ঢাকার রাস্তায় যানজটের অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাইভেট গাড়ি নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে সড়কের সীমাবদ্ধতা ও পরিমাণ বিবেচনা করা উচিত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছে গ্রাহকদের গাড়ি কেনার ঋণ দিতে। তা ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে গাড়ি কেনায় ঝোঁক তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনামাফিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি এই শহরে। উন্নত দেশে সাধারণত স্কুলকেন্দ্রিক যাতায়াত বা ট্রিপটাকে কখনো প্রধান সড়কে যেতে দেয় না। সেখানকার স্কুলগুলো হয় কমিউনিটিভিত্তিক। দূরের বাচ্চাদের জন্য নিজস্ব স্কুলবাস থাকে।

গণপরিবহনের সমস্যা সমাধানে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা নগর পরিবহনের প্রথম বাসসেবা চালু হয়েছিল। পরে আরও দুটি রুটে (চলাচলের সুনির্দিষ্ট পথ) এই সেবা চালু হয়েছিল। এখন একটি রুটে আর বাস চলছে না, বাকি দুটিও বন্ধ হওয়ার পথে। দুই ধাপে মোট ১৫০ বাস দিয়ে চালু হয়েছিল ঢাকা নগর পরিবহনের সেবা। এখন বাস চলছে মাত্র ৩০টি, তা-ও শুধু সরকারি সংস্থা বিআরটিসির। বেসরকারি কোম্পানিগুলো শুরুতে সরকারের এই উদ্যোগে থাকতে আগ্রহ দেখালেও পরে তারা সরে গেছে।

২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা ‘বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ’ চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়া। সহজ শর্তের ঋণে নতুন বাস নামানো। বাস চলবে পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির অধীন। মালিকরা বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পাবেন। বেসরকারি বাসমালিকরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের বাস কিনে নিতে। তা আর হয়ে ওঠেনি। ফলে উদ্যোগটি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। যে একটি বেসরকারি কোম্পানি বাস নামিয়েছিল তারাও লোকসানের ভারে সরে যায়।

এবার আসা যাক রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিয়ে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো বিশেষ করে উবার শুরু থেকেই কয়েক ধরনের প্রমো ও মাসে ৮০ হাজার টাকা আয়ের নিশ্চয়তামূলক বিভিন্ন চমকপ্রদ প্রচারণা শুরু করে, ফলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চালকরা এটিকে পেশা হিসেবে নিতে শুরু করে। কেউ প্রাইভেটকারের চাকরি ছেড়ে, কেউ ট্যাক্সি চালানো ছেড়ে, কেউ বা রেন্ট-এ-কার ছেড়েÑ এমনকি কোনো কোনো শিক্ষিত বেকার যুবকও জুঁতসই চাকরি না পেয়ে এ প্ল্যাটফরমকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। রিকশা বাদ দিয়ে অনেকে মোটরসাইকেল নিয়েছেন। বহু চালক আছেন যাদের কেউ তাদের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে অথবা ধারদেনা করে আবার কেউবা মোটা অংকের সুদে লোন করে গাড়ি কিনেও এ পেশায় যুক্ত হন। যাদের প্রত্যেকেই আজ ঋণের দায়ে জর্জরিত। এর বড় কারণ নগর পরিবহনে বিশৃঙ্খলা। যানজটে সড়কে আটকা পড়ে এসব চালক এখন বলছেন, হাতেগোনা ট্রিপে জীবিকা নির্বাহ দায়। আবার রাইডশেয়ারিং নিয়ে অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে ৯৯৯ সেবার সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি এখনো।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, গণপরিবহনে এখন দরকার সেবার প্রতিযোগিতা। সড়কপথ রেখে মানুষ মেট্রোতে যাচ্ছে। বেসরকারি পরিবহন মালিকদের এদিকে নজর দেওয়া দরকার। বিআরটিসিও সার্ভিস দিচ্ছে যাত্রীপরিবহনে। আর সড়কপথের শৃঙ্খলায় সব সংস্থার সমন্বয়ে কাজ চলছে।