গন্তব্যহীন বিআইডব্লিউটিসি

তাওহীদুল ইসলাম
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
গন্তব্যহীন বিআইডব্লিউটিসি

স্বাধীনতা যুদ্ধে সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কঠিন পরিস্থিতি উত্তরণে নৌপথে জোর দেওয়া হয়। তাই ১৯৭২ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে ফেরি, জাহাজ এবং অন্যান্য নৌযানের মাধ্যমে দেশের মূল ভূখ-ের সঙ্গে দীপাঞ্চল এবং সড়কপথে নদীর সংযোগ স্থাপন করে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে আসছে। তবে দীর্ঘদিন ধরেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, দক্ষতা ও পেশাদারির অভাবে ভুগছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্বায়ত্তশাসিত সেবামূলক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নদীমাতৃক দেশ হওয়ার পরও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে চলতে পারছে না বিআইডব্লিউটিসি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ নদীতে চলা ফেরি ও নৌযানগুলোর গন্তব্য কী হবে তা ঠিক না করা এবং কয়েকটি রুটে চলা ওয়াটার বাসগুলোর পরিণতি দেখে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্থাটি যেন পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য ছাড়াই চলছে।

তবে আশার কথা শুনিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। অতীতে বিআইডব্লিউটিসির সুস্পষ্ট সমীক্ষা না থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেছেন, সংস্থাটির উন্নয়ন এবং সেবার পরিধি বাড়াতে মন্ত্রণালয় মনোযোগ দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দূরদর্শিতা ও দক্ষ কর্মকর্তার ঘাটতি রয়েছে সংস্থাটিতে। এর আয়ের সিংহ ভাগ আসে ফেরি সার্ভিস থেকে। অথচ পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের অভাবে করপোরেশনের জ¦ালানি ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে জটিলতায় আছে। পদ্মা সেতু চালুর পর শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে গাড়ি পারাপার কমে যাবে- এটি আগে থেকেই চিন্তা করেননি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। এরপর বিকল্প কোন কোন রুটে ফেরি চলতে পারে তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। এ রকম অদূরদর্শিতার নেতিবাচক পরিণাম বয়ে এনেছে সংস্থাটি। মানে গন্তব্য না দেখেই যেন পথ চলছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান।

দেরিতে হলেও দেশের যোগাযোগব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ফেরি সার্ভিসে গুরুত্ব দিয়েছে সংস্থাটি। বিশেষ করে উপকূলীয় ও চরাঞ্চলে ফেরি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে যাতায়াত সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন করে সারাদেশে নৌপথ সার্ভে করার মধ্য দিয়ে নৌপরিবহন ব্যবস্থায় উন্নয়নে বিশদ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সড়ক ও রেলপথের পাশাপাশি নৌপরিবহনকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় জনপ্রিয় করতে চায় সংস্থাটি। তবে এখনো লাভের মুখ দেখতে পারেনি।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিসির সব কিছুতে লাভ খুঁজলে হবে না। সেবার দিক আছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আমি দায়িত্ব পেয়ে দেখি, সংস্থাটির কার্যক্রমে যে ধরনের বিস্তারিত সমীক্ষা থাকা উচিত ছিল, তা নেই। এই করপোরেশন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে সড়কপথের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা করে ফেরির মাধ্যমে। আমরা চেষ্টা করছি, ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে কোথায় কোথায়

যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল ও চরাঞ্চলে নৌপরিবহনে কাজ চলছে। আমরা হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রাঙাবালি, চরমন্তাজ, রৌমারী ও চিলমারির মতো জায়গায় ফেরি সার্ভিসে গুরুত্ব দিয়েছি।’

দেশের সড়ক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ নদী সংযোগে ফেরি সার্ভিস দিচ্ছে সংস্থাটি। ফেরির পাশাপাশি বর্তমানে ১৩১টি বাণিজ্যিক জাহাজ ও ৫৩টি সহায়ক জাহাজের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিআইডব্লিউটিসি। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি নতুন ফেরি ও ১০টি নতুন পন্টুন নির্মাণ করে বিভিন্ন ফেরি রুটে সার্ভিস দিচ্ছে সংস্থাটি। তবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে রাজধানী ঢাকার বৃত্তাকার নৌপথে ওয়াটার বাস সার্ভিস প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের পানিতে দুর্গন্ধ ও নদীকেন্দ্রিক সড়ক নেটওয়ার্ক না থাকাসহ নানা কারণে সেগুলো যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। বিআইডব্লিউটিসির বহরে বর্তমানে ১২টি ওয়াটার বাস রয়েছে। প্রথমবারের মতো ‘ওয়াটার ট্যাক্সি’ যাত্রা করে শুরু ২০০৪ সালে। তবে মাসখানেক পর বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। এরপর ২০১৩ সালে।

ঢাকাকেন্দ্রিক নৌযানের ব্যবসা কমে যাওয়ায় ওয়াটার বাস চলাচলে বাধা দেওয়ার নজির একাধিকবার। একপর্যায়ে জ¦ালানি খরচ বহন কঠিন হয়ে পড়ায় চার্টার তথা ভাড়ার মাধ্যমে পরিচালনার দিকে যায় বিআইডব্লিউটিসি। এখন সব ওয়াটার বাস সদরঘাটকেন্দ্রিক নয়। যাত্রীর অভাবে ঢাকার বাইরেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু চলছে পর্যটকবাহী হিসেবে। কিছু আছে নদী পারাপারে।

বিআইডব্লিউটিসির তথ্যমতে, চারটি ওয়াটার বাস বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলোর দুটি চট্টগ্রামে, একটি নারায়ণগঞ্জে ও অপরটি রয়েছে ঢাকা ঘাটে। সংস্থার অধীনে চলছে ৪টি। ঢাকা ঘাটে দুটি ও দুটি নারায়ণগঞ্জে। তিন ক্যাটাগরির ওয়াটার বাস রয়েছে সংস্থার বহরে। পর্যটক বহনের কাজে একটি ওয়াটার বাস চলে মেসার্স ফ্রিডম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের অধীনে মোংলা-সুন্দরবন রুটে। ৮৩ আসনের এ বাসের মাসিক ভাড়া ২২ হাজার ২০০ টাকা। আরেকটি ওয়াটার বাস চলে ওয়াসিম এন্টারপ্রাইজের অধীনে নবাববাড়ী-আগানগর রুটে মাসিক ২৬ হাজার ৮৪০ টাকায়। ৪৮ হাজার টাকায় সুনাম অয়েল সাপ্লায়ার্সের আওতায় চলে দুটি ওয়াটার বাস শ্যামবাজার-কালীগঞ্জ তৈলঘাট রুটে। ওয়াটার বাসের মান ও আসন বিবেচনায় ভাড়ায় ভিন্নতা থাকে দরপত্রে।

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ড. একেএম মতিউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ওয়াটার বাস সার্ভিসের আটটি সচল। এই প্রকল্পের অধীনে আরও কিছু ওয়াটার বাস বহরে যুক্ত হবে। যাত্রী ও পর্যটক সেবায় এ সার্ভিস সবার পছন্দের বাহন হতে পারে। তিনি বলেন, তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন সপ্তাহখানেক হলো। বিআইডব্লিউটিসির সব কার্যক্রম আরও উন্নত হবে। ফেরি ও জাহাজ সার্ভিস নিয়েও বৃহৎ পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

জানা গেছে, একটি প্রকল্পের আওতায় ১৮ কোটি ১২ লাখ টাকায় দুটি উপকূলীয় যাত্রীবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল মতিন ও এমভি মনিরুল হক পুনর্বাসন করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ৪টি যাত্রীবাহী সি-ট্রাক। দীর্ঘ ৬৩ বছর পর ঢাকা-বরিশাল-খুলনা রুটে ৭৬৪ যাত্রী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন দুটি যাত্রীবাহী জাহাজ ‘এমভি বাঙ্গালি’ ও ‘এমভি মধুমতী’ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮টি সি-ট্রাক, ৪টি উপকূলীয় যাত্রীবাহী জাহাজ, ৩টি ক্রুজ ভেসেল, ৩টি আধুনিক যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণাধীন। আগামী বছর তথা ২০২৫ সালে এগুলো বহরে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নৌযানে জ¦ালানি সরবরাহের জন্য তিনটি ট্যাঙ্ক লরি কিনেছে বিআইডব্লিউটিসি।

বিআইডব্লিউটিসির সূত্র জানায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ফেরি ও পন্টুনের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহন করা হয় ১ কোটি ৭৭ লাখ ৩৩ হাজার ৪৮৮ জন। সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে যাত্রী পরিবহন করে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ৬৮৮ জন। এই ১২ বছরে প্রায় ৩২ লাখ যাত্রী হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে যানবাহন পারাপার হয়েছে ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮৪টি এবং ১২ বছর পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে যানবাহন পার হয়েছে ২০ লাখ ৬২ হাজার ৩৩৬টি। এ সময় যানবাহনের পারাপারের সংখ্যা বাড়ে ৪ লাখের বেশি। এ খাতে সংস্থাটি এক যুগ আগে আয় করেছিল ১৭০ কোটি ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬১৮ টাকা। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় করে ৩২৩ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ৪০৬ টাকা। অর্থাৎ ১২ বছরের ব্যবধানে আয় বাড়ে ৩০০ কোটি টাকা।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা মনে করেন, বিশদ ও যথাযথ সমীক্ষাপূর্বক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে দেশের নৌপরিবহন ব্যবস্থায় বড় ভূমিকা রাখতে পারবে সংস্থাটি। একই সঙ্গে লাভজনকও হবে সরকারের বাণিজ্যিক সংস্থাটি।