সংসার চলছে ব্যাংকঋণে

জিয়াদুল ইসলাম
৩০ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সংসার চলছে ব্যাংকঋণে

দেশে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। তবে সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি বেশির ভাগ মানুষের। ফলে এসব মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সংসারের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাচ্ছে। এর প্রভাবে ব্যাংকের ভোক্তাঋণে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর হতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ভোক্তাঋণ বেড়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা বা ১৬ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি সার্বিক বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি। উচ্চসুদ ও ব্যাংকের অনাগ্রহের কারণে শেষ তিন মাসে ভোক্তাঋণ সামান্য কমলেও ক্রেডিট কার্ড, শিক্ষা ব্যয় ও বেতন হিসাবের বিপরীতে ব্যক্তিঋণ নেওয়ার পরিমাণ এবং নতুন গ্রাহক বেড়েছে। একই সঙ্গে জমি বা প্লট, গাড়ি, মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ও ফার্নিচার ক্রয়েও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তবে কমে গেছে ফ্ল্যাটের ঋণ। গত এক বছরে ভোক্তা খাতের আওতায় প্রায় সব উপখাতেই ঋণ বিতরণ বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাপরবর্তী অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ অন্যান্য কারণে দেশে পণ্য ও সেবামূল্য বেশ চড়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় ও সংসারের খরচ বেড়েছে সব শ্রেণিপেশার মানুষের। তবে বাড়তি এই খরচের অনুপাতে আয় বেড়েছে এমন মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মুহাম্মদ আকবর। কোনো মাসে বেতন পেতে বিলম্ব হলে ক্রেডিট কার্ডের টাকায় সংসারের খরচ সামলান। গত ডিসেম্বর মাসের বেতন চলতি মাসে পেতে বেশ বিলম্ব হওয়ায় ক্রেডিট কার্ডে বেশি ঋণ করতে হয়েছে তাকে। মুহাম্মদ আকবর আমাদের সময়কে বলেন, তার ক্রেডিট কার্ডে খরচের মাসিক লিমিট দেওয়া আছে ৫০ হাজার টাকা। সঠিক সময় বেতন হলে এই লিমিটের অর্ধেকও খরচ করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু চলতি মাসে বেতন পেতে বেশি বিলম্ব হয়েছে। এ কারণে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সব জিনিসপত্রের দামই এখন চড়া। ফলে সংসারের খরচও আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।

সাধারণভাবে ভোক্তাঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয়। ভোক্তাঋণ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে ভোক্তাঋণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ভোক্তাঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে মানুষের সংসারের খরচ ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি অনেকের, বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের। ফলে খরচের তালিকা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। আবার অনেকেই তা পারছেন না। আর যারা পারছেন না, তারা ঋণ নিয়ে হলেও বাড়তি খরচ সামাল দিয়ে যাচ্ছেন।

একই অভিমত ব্যক্ত করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় না বাড়ায় ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে দীর্ঘদিনের ভোগ্যব্যয়ের ন্যূনতম মান বজায় রাখার জন্য অনেকেই পুঁজি ভেঙে খাওয়ার পাশাাপশি ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছেন। ভোক্তাঋণ মূল্যস্ফীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছেÑ এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেই ভোক্তাঋণ বেড়েছে। এটা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে তা ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ভোক্তাঋণে খানিকটা কড়াকড়ি আরোপ করে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে করোনার কারণে স্থবির অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরিতে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর ভোক্তাঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে সব ধরনের অশ্রেণিকৃত ভোক্তাঋণে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হতো, যা ওই সময় কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্যসব ভোক্তাঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে ভোক্তা খাতে ঋণ বিতরণে বেশ আগ্রহ দেখায় ব্যাংকগুলো। আবার সুদের হার তুলনামূলক কম হওয়ায় সাধারণ মানুষও সংসারের বাড়তি খরচসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এই ঋণ নিতে উৎসাহিত হন। তবে চলতি অর্থবছরের এসে ঋণের সুদের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভোক্তা খাতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণে আগ্রহ কিছুটা কমেছে। আবার সুদের হার বাড়ায় গ্রাহকরা খুব প্রয়োজন ছাড়া ভোক্তাঋণ নিচ্ছেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ভোক্তাঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। ৩২ লাখ ৯৭ হাজার ১৭৯ জন গ্রাহক এই ঋণ নিয়েছেন। গত এক বছরের ব্যবধানে ভোক্তাঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তবে শেষ তিন মাসে ৮৯৬ কোটি টাকার মতো ভোক্তাঋণ কমেছে। যদিও একই সময় ভোক্তাঋণের নতুন গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার ২২০ জন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ তিন মাসে নিজ বেতনের ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে ঋণ নেওয়া গ্রাহক বেড়েছে ৪ হাজার ৩৬২ জন। আর ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। আর গত এক বছরের ব্যবধানে এই ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। গত এক বছরে ক্রেডিট কার্ডের নতুন গ্রাহক বেড়েছে রেকর্ড ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৭ জন। আর ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ২৪৫ কোটি টাকা। একই সময়ে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ও গ্রাহক দুই-ই বেড়েছে। গত এক বছরে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। আর গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ২৮ হাজার ৭৮৭ জন। গত এক বছরে শিক্ষার ব্যয় নির্বাহে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৭৬৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে ডাক্তারসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের নেওয়া ঋণ নেওয়া বেড়েছে ৫৪৮ কোটি টাকা।

বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য তথা টিভি, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ও ফার্নিচার ক্রয়েও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে গত এক বছর। এ সময়ে এসব পণ্য কেনা বাবদ ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৫৮ জন গ্রাহক ঋণ নেন ৩৪ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন মাসে ঋণ নিয়েছেন ৩৩৩ কোটি টাকা। এ সময়ে গাড়ি ও মোটরসাইকেল কেনায় ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ তিন মাসে মোটরগাড়ি কেনায় ঋণ বেড়েছে প্রায় ৮৮ কোটি টাকা।

অন্যদিকে গত এক বছরে ফ্ল্যাট কেনায় ঋণ বিতরণ ২ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা বাড়লেও সর্বশেষ তিন মাসে কমেছে প্রায় ২৭৪ কোটি টাকা। তবে একই সময়ে প্লট কেনায় ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১৪২ কোটি টাকা। আর গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১ হাজার ১০৩ কোটি টাকা।