জেল-জরিমানার পরও থামেনি দালাল পোষা

ইউসুফ সোহেল
২৮ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
জেল-জরিমানার পরও থামেনি দালাল পোষা

দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্রাণে বাঁচলেও চিকিৎসা চালাতে গিয়ে এখন নিঃস্ব হতে বসেছেন ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা চালক মো. শাহাবুদ্দিন ফকির। মাদারীপুরের কেন্দুয়া ইউনিয়নের এই বাসিন্দা রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান- নিটোর) চিকিৎসা নিতে রাজধানীতে এসে দালালের খপ্পরে পড়েন। গত ৭ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের প্রাইম অর্থোপেডিক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেওয়া হয় তাকে। বিল দিতে না পারায় ১৪ দিনের মাথায় নামিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারটির দাবি, তত দিনে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে তিন লাখের বেশি টাকা। তবে তাদের দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার টাকার প্রাপ্তি রসিদ। পরিবারটি বলছে, থানায় অভিযোগ দায়েরের পর ২০ হাজার টাকায় সমঝোতা করতে তাদের বাধ্য করেছে পুলিশ।

রোগী বাগিয়ে এনে প্রতারণা ও অপচিকিৎসার দায়ে ২০২০ সালের ১৩ মে মোহাম্মদপুরের মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের উল্টোপাশে) অবস্থিত হাসপাতালটির মালিক আবদুর রাজ্জাকসহ ১১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-২। রোগী আটকে রেখে অর্থ আদায় করায় তাদের ২২ লাখ টাকা জরিমানা ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রদান করেন র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তিন বছর পরও থামেনি তাদের অপতৎপরতা।

গত বছরের ৫ নভেম্বর মাদারীপুরে একটি বাসের সঙ্গে শাহাবুদ্দিনের অটোরিকশা ও একটি প্রাইভেটকারের সংঘর্ষ হয়। এতে অটোরিকশা ও প্রাইভেটকারের ৬ যাত্রী নিহত হয়। দুর্ঘটনায় শাহাবুদ্দিনের বাঁ পা ও ডান হাত প্রায় গুঁড়িয়ে যায়। পথচারীরা তাকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। ৭ নভেম্বর তাকে নিয়ে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের পথে রওনা দেন স্ত্রী মুক্তা বেগম। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে পরিচিত একজনের সঙ্গে কথা বলতে অ্যাম্বুলেন্স থামাতেই দালালের খপ্পরে পড়েন তারা। পঙ্গু হাসপাতালে হাত-পা কেটে ফেলার ভয় দেখিয়ে দালালরা তাদের রাস্তার ওপারে প্রাইম হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর দুর্ভোগ-যন্ত্রণায় যোগ হয় নতুন মাত্রা।

মুক্তা বেগম বলেন, চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় হাসপাতালে থাকা ১৪ দিনের মধ্যে সাত দিন চিকিৎসা মেলেনি। প্রায় সোয়া তিন লাখ টাকা আদায়ের পর তাড়িয়ে দেওয়া হলে শাহাবুদ্দিনকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দুই মাস চিকিৎসা নিয়ে গতকাল শনিবার গ্রামের পথ ধরেছেন তিনি। এর মাঝে ৫ বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে তার শরীরে। বাঁ পায়ে নাট-বল্টু ঢুকিয়ে প্লাস্টার করে রাখা হয়েছে। ডান হাতটিও হয়ে গেছে নিথর।

এখন অটো চালানোর চিন্তায় পড়েছেন শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, প্রাইম হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায় পায়ের সঙ্গে হাতটাও অকেজো হয়ে গেল; কেমনে অটো চালাব? পরিবার নিয়ে আমি তো অথৈ সাগরে পড়লাম। পাশেই শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছিলেন স্ত্রী মুক্তা। তিনি জানান, প্রাইম জেনারেল হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা সেবা না পেলেও তিন লাখ ২০ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক ধাপে ৮৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া কয়েক আত্মীয়ের মাধ্যমে দুর্ঘটনায় জড়িত বাস কোম্পানি শাকুরা পরিবহনের কাছ থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা আদায় করেছে।

গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় অভিযোগ জানান মুক্তা বেগম। তিনি আমাদের সময়কে জানান, গত মঙ্গলবার রাতে জোর করে তার কাছ থেকে সমঝোতার কাগজে সই নিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এএসআই রাসেল হাওলাদার।

মুক্তার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা রাসেল হাওলাদার। তিনি বলেন, ওই সিএনজি চালকের স্ত্রী স্বেচ্ছায় কাগজে সই করেছেন। আমরা বারবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে বলেছি, কিন্তু তিনি রাজি হননি। ক্ষতিপূরণ বাবদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের দেওয়া হয়েছে।

প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন প্রাইম জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মো. আরমান বলেন, হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, অন্যের প্ররোচনায় থানায় অভিযোগ দিয়েছেন এমন কথা লিখে জেনে-বুঝে সমঝোতায় সই করেছে শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী। মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের টাকা দেওয়া হয়েছে।

২০২০ সালে প্রাইম জেনারেল হাসপাতালের মালিকসহ ১১ জনকে (বাবুল হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, আকাশ, দুলাল, কামাল হোসেন, জাকির, মোকাররম হোসেন, দুদু মিয়া, মোবারক খাঁ, বিল্লাল ওরফে পিচ্চু ও ফারুক হোসেন) ২২ লাখ টাকা জরিমানা ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের প্রসঙ্গ টানতেই মো. আরমান বলেন, ওই সমস্যা মিটমাট হয়ে গেছে।

প্রাইম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের হাসপাতালের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে। নিয়ম মেনে ওই রোগীকে সুস্থ করে তুলতে আমরা সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছি।