৭ মাসে মঞ্জুরের সম্পদ বেড়ে যায় ২২৮ গুণ
গ্রাহকের টাকা লুটপাট করে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম। মাত্র সাত মাসে তার সম্পদ বেড়েছে ২২৮ গুণ। বেনামেও সম্পদ গড়েছেন তিনি। স্ত্রীর নামে গড়েছেন শতকোটি টাকার সম্পদ এবং শাশুড়ির নামে ঢাকার অভিজাত এলাকায় আলিশান বাড়িও করেছেন তিনি। দেশের ৬৫ জায়গায় ৩১ কোটি ৮০ লাখ টাকার জমি কিনেছেন। অধিকাংশ জমি গাজীপুর জেলায়। চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি মঞ্জুর আলমের জামিন শুনানি আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। তবে হাজার হাজার গ্রাহক কবে নাগাদ তাদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাবেন, সেটি বলতে পারছেন না সরকারের কেউ। এতে হতাশা বাড়ছে গ্রাহকদের।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার, তার স্ত্রী ও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া চৌধুরী ৪২১ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন। এ নিয়ে ভোক্তা অধিকার ও পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন দুই হাজারের বেশি ভুক্তভোগী। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির মামলায় মঞ্জুর আলম ও তাদের সহযোগী এসকে ট্রেডার্সের মালিক আল মামুনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তবে মঞ্জুর আলমের স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরী এখনো গ্রেপ্তার এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
তাওহীদ তুহিন নামে একজন ভুক্তভোগী গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আলেশা মার্টে তিনি ২৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। ভোক্তা অধিকারের মধ্যস্থতায় গত বছরের মাঝামাঝি ১ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন। এখনো প্রায় ২৩ লাখ টাকা আটকে আছে। তার মতে, কয়েক হাজার মানুষের কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। তারা সবাই এখন নিঃস্ব।
শিক্ষার্থী তাওহীদ তুহিন বলেন, তিনি একটি পেমেন্টের ১১ লাখ ৪১ হাজার টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে মামলা করেছেন। খরচের ভয়ে বাকি টাকার মামলা করেননি তিনি। তবে মামলা করা অর্থ কবে নাগাদ ফেরত পাবেন সেটিও বলতে পারছেন না তিনি। তার অভিযোগ, সরকারি কোনো সংস্থাই তাদের টাকা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে জোরালো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বর্তমানে আলেশা মার্টের মানিলন্ডারিং মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের নির্দেশে পুলিশ মঞ্জুর আলমের বেশ কিছু সম্পদ জব্দ করেছে। গ্রাহকের টাকা লুটপাট করে মঞ্জুর আলম ও তার স্ত্রী-শাশুড়িসহ স্বজনদের নামে গড়া বিপুল সম্পদের বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এ ছাড়া নতুন নতুন সম্পদের সন্ধানও পাওয়া যাচ্ছে। তবে গ্রাহকের টাকা ফেরতের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।
রাজধানীর বনানী থেকে গত ১৪ জানুয়ারি মঞ্জুর আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর ৯টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানামূলে আদালতে হাজির করা হলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু চৌধুরী তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর পর ১৬ জানুয়ারি আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানের পক্ষে জামিন আবেদন করা হয়। ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন সাত এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিব দুটি মামলায় জামিন মঞ্জুর করেন। তবে অন্য মামলায় তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার চেক-ডিজঅনারের মামলায় মঞ্জুর-সাদিয়া দম্পতিকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া চেকের সমপরিমাণ তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
মঞ্জুর আলমের স্থাবর সম্পত্তির নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালে মাত্র সাত মাসের মধ্যে তিনি দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ৬৫টি স্থানে শুধু জমি কিনেছেন ৬১ বিঘা। এসব জমির দলিলমূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৩১ কোটি ৮০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। তবে প্রকৃত বাজারমূল্য ১৫০ কোটি টাকার বেশি। অধিকাংশ জমি কিনেছেন ২০২১ সালের মে, জুন ও জুলাই মাসে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঠাকুরপাড়ায় আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেডের পক্ষে মঞ্জুর আলম ২০২১ সালের ৩০ জুন ১৭৪.৫ শতাংশ (দলিল নম্বর-৫৩৭৩) কিনেছেন। যার দলিলমূল্য ধরা হয়েছে ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। একই দিন গাজীপুরের কালিয়াকৈরের লস্করপাড়া থেকে ৪০ শতাংশ জমি কেনেন। যার দলিলমূল্য ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
মঞ্জুরুল আলমের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীর তথ্য তুলে ধরে সিআইডি বলছে, বেতন ও আনুষঙ্গিক বেতন মিলে মঞ্জুরের আয় ছিল মাত্র ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। আর সাত মাসের ব্যবধানে তিনি ৩১ কোটি টাকার জমি কেনেন। সেই সঙ্গে নামে-বেনামে গড়েছেন বিপুল অংকের সম্পদ।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, সাদিয়া চৌধুরীর নামে গুলশান-২ ও গেন্ডারিয়ায় দুটি আলিশান ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। শাশুড়ি লায়লা চৌধুরীর নামে ধানমন্ডিতে পেয়েছে একটি আলিশান ফ্ল্যাটের সন্ধান। এ ছাড়া বিভিন্ন নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে তদন্ত সংস্থা।
২০২০ সালের ২৬ জুলাই আলেশা মার্ট যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে আলেশা মার্টের যাত্রা শুরু ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি। যাত্রা শুরুর পর কম মূল্যে মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য সরবরাহের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে বহু গ্রাহককে পণ্য কিংবা টাকা ফেরত না দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে পাচার (মানিলন্ডারিং) করে। টাকার জন্য আন্দোলন করলে মঞ্জুর আলম প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজে কমেন্ট সেকশন বন্ধ করে প্রতিদিন লাইভে এসে গ্রাহকদের প্রতিশ্রুতি দিতেন। গ্রাহকদের মামলায় গ্রেপ্তার হলে তিনি আর টাকা ফেরত দিতে পারবেন না বলে ভয় দেখান। এভাবে সময় ক্ষেপণ করে আত্মসাৎ করা টাকার বড় অংশ পাচার করেছেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ আলেশা মার্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেড, আলেশা টেক লিমিটেড, আলেশা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট লিমিটেডসহ অন্তত ১০ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন