লিথুনিয়ার লিউবিন্সকাসের মনে আজও আছে আবাহনী

ক্রীড়া প্রতিবেদক
২৪ জানুয়ারী ২০২৪, ২০:২৫
শেয়ার :
লিথুনিয়ার লিউবিন্সকাসের মনে আজও আছে আবাহনী

লিথুনিয়ার জাতীয় দলের প্রবাদপ্রতিম প্রাক্তন কোচ লিউবিন্সকাস এখনো বাংলাদেশের আবাহনীকে মনে রেখেছেন, আবাহনীর নাম তার প্রোফাইলে এখনও উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে আবাহনীতে যোগ দিয়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে, তিনি দ্রুতই সবার মন জয় করে নেন।

তার কোচিংয়ে, আবাহনী ফেডারেশন কাপের ফাইনালে ১-০ গোলে জয়লাভ করে তৎকালীন এশিয়ার অন্যতম প্রধান দল ঢাকা মোহামেডানকে হারিয়ে । ১৯৮৮ সালের আবাহনী স্কোয়াডে মাত্র দুইজন স্বদেশি বনে যাওয়া বিদেশি শ্রীলঙ্কান- পাকির আলী এবং প্রেমলাল, উদীয়মান মুন্না কৃষ্ণা রুপু এবং অভিজ্ঞ গোলরক্ষক মোহসিন, আসলাম ওয়াসিম আবু ইউসুফ, ছোট কামাল এবং মোহামেডানের থেকে ফেরত রঞ্জিত আর কাজি কামালদের নিয়ে তরুণ কোচ লিউবিন্সকাস দল গঠন করতে হয়েছিল। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের অংশ নেওয়া কিংবদন্তি কোচ নাসের হেজাজির দক্ষ হাতে পরিচালিত দলটি বিজন তাহিরি, নালজেগার এবং উদীয়মান থাই সুপারস্টার রান্নাচাইয়ের মতো প্রতিভাবান বিদেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে করেছিল। দেশীয় তারকা শাব্বির, কানন, কায়সার, মন্টু রেহান, বাবুল জনি এবং এমেলীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এটি একটি শক্তিশালী দল ছিল মোহামেডানের।

লিউবিন্সকাস চতুরতা শুধু মোহামেডানের আভিজাত্যই ধূলিসাৎ করেনি, আবাহনীর ঘরে ফেডারেশন কাপও এনে দিয়েছে। এই বিচক্ষণতার কারণেই আজও আবাহনী তাদের সমর্থকদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

লিউবিন্সকাস সম্পর্কে জানতে পারি সোনালি শৈশবের কিংবদন্তি ফুটবলার মুন্নার এক সাক্ষাতকারে। তিনি বলেছিলেন তার খেলোয়াড়ি জীবনে যেসব বিদেশি কোচের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে লিউবিন্সকাস সবার থেকে সেরা। মনে রাখা দরকার, মুন্না যেসব বিদেশি কোচের অধীনে খেলেছন তাদের মধ্যে আছেন অটো ফিস্টার, মার্কও ভিলইচ, নাসের হেজাজি, বগদানভ, অলদ্রিচ সোওয়াব, মান ইয়াং কাং সামির সাকের নায়েমুদ্দিনসহ আর অনেকে। এসব কোচের মধ্যে যখন আলাদাভাবে লিউবিন্সকাসের কথা বলেন তখন ভাবতে হবে কি মানের কোচ তিনি ছিলেন!

আর তাই, সেই শৈশব থেকে আমি লিউবিন্সকাস খুঁজেছি। এখন পৃথিবীটা ছোট হতে হতে হাতের মোবাইল ফোনে এসেছে । এই কারণে প্রবাদপ্রতিম এই কোচকে আমার নেটওয়ার্কের ভেতরে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার কাছ থেকে তার জীবনের গল্প, এবং বিশেষভাবে আবাহনীতে আসার কথা এবং কেন লীগ শেষ না করে তার চলে যাওয়া সব ঘটনার পশরা নিয়ে বসেছিলেন আমার সঙ্গে। অনেক সময় তিনি আমাকে দিয়েছিলেন যা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।

লিউবিন্সকাস তার গল্পের পসরা নিয়ে বসলে জানতে পারি তার শৈশবের কথা । লিথুয়ানিয়া প্রজাতন্ত্রে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। লিথুয়ানিয়া, অন্যান্য বাল্টিক দেশগুলোর মতো রাশিয়া দ্বারা দখল করা হয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে তারা ছিলেন।  

১৯৮৩-১০৮৫ সালে এফসি ভিলনিয়াস জালগিরিসের প্রধান কোচ ছিলেন। জালগিরিস ক্লাব সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষ লিগে খেলেছে। ১৯৮৫-১৯৮৭ সালে, তিনি কোচের মস্কো উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। এটি ছিল সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবল একাডেমি। পড়ে ইটালি কিংবদন্তি ফ্যাবিও ক্যাপেলোর অধীনে মিলান ক্লাবে ইন্টার্নশিপ করেছিলেন ।

স্নাতক হওয়ার পর, লিউবিন্সকাস ফোন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ফুটবলের প্রধান, ফিফার ভাইস প্রেসিডেন্ট, ভি. কোলোসকভকে বিদেশে চাকরি কথা বলেছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি একটি বিদেশি দেশে কাজ করার প্রস্তাব দ্বারা খুবই প্রলুব্ধ ছিলেন। তার মনে আছে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পর বিপুল সংখ্যক ফুটবল সমর্থক তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাকে ক্লাব ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আবাহনী ক্লাব একজন দোভাষীর মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিল এবং কথোপকথনের পরে, তৎকালীন পরিচালকদের উপস্থিতিতে, ইংরেজিতে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, কারণ তিনি যখন দোভাষীর সঙ্গে কথা বলেন, খেলোয়াড়রা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে, কিন্তু বুঝতে পারতেন না এবং যখন দোভাষী কথা বলে তখন তারা (খেলেয়ার) আবার শুনতে পান না। পরে তিনি ইংরেজিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন।

আবাহনীর প্রথম দিনগুলোতে লিউবিন্সকাস প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পোর্টেবল গেট এবং অন্যান্য সরঞ্জামগুলো সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। কিন্তু খুব বেশি লাভ হয় নাই বা ক্লাব তেমন গুরুত্ব দেয় নাই। তার কোচিং পদ্ধতি দলে নতুন ছিল, কিন্তু সানন্দে গৃহীত হয়েছিল। তিনি মনে করেন, প্রশিক্ষণটি ছিল আকর্ষণীয়, তীব্র এবং খেলোয়াড়দের দ্বারা গ্রহণযোগ্য। অনুশীলনের সময়, ক্লাবের অনেক ভক্ত মাঠের কাছে জড়ো হয়েছিল। তিনি ফুটবল এবং প্রশিক্ষণ বোঝার জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে খেলোয়াড়রা তাকে বিশ্বাস করে। কিছু খেলোয়াড়ের জন্য তাদের সেরাটা খুঁজে বের করার জন্য তাদের কৌশলে কিছু পরিবর্তন করার খুব প্রয়োজন ছিল। দলের কর্তারা তাকে বিশ্বাস করেছিল এবং কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।

ফুটবলে খেলোয়াড়দের বোঝা এবং কোচকে বিশ্বাস করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফেডারেশন কাপ ফাইনালে আবাহনীর জয় ছিল পরিশ্রম, পারস্পরিক আস্থা এবং সঠিকভাবে নির্বাচিত কৌশলের ফল। আবাহনীর খেলোয়াড়দের দক্ষতা কোনোভাবেই মোমেডানের চেয়ে ভালো ছিল না।

১৯৮৮ সালে, রাশিয়ার দখল থেকে লিথুয়ানিয়াকে মুক্ত করার আন্দোলন শুরু হয়। রাশিয়ান কনসাল তাকে ডেকে বললেন যে লিথুয়ানিয়া নিজেদের দখলমুক্ত করতে চায়, তাই তাকে অবশ্যই তাকে মস্কোতে ফেরত পাঠাতে হবে। তিনি স্বেচ্ছায় দল ছাড়েননি, রাশিয়ান কনসাল তাকে পাঠিয়েছে। তিনি যে কাজটি শুরু করেছিলেন তা চালিয়ে যেতে এবং চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে চেয়েছিলেন।

লিউবিন্সকাস এক ধরনের বিশ্ব রাজনৈতিক শিকার হয়েছিলেন। তার চলে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ক্লাব পরিচালকরা জানতেন কি না তিনি তা জানেন না। পরবর্তী পর্যায়ে, বাংলাদেশি পক্ষ থেকে কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, আর কোনো অফারও আসেনি।

১৯৯০ সালে, লিথুয়ানিয়া রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং আলাদা হয়ে যায়। ৩৩ বছর ধরে লিথুয়ানিয়া বর্তমানে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র। লিথুয়ানিয়ান জাতীয় ফুটবল দল কোচ হিসাবে দুই দফায় ৮০টি অফিসিয়াল এবং ১৯টি প্রীতি ম্যাচে তিনি দায়িত্বে ছিলেন লিউবিন্সকাস। যার মধ্যে দ্বিতীয় দফার ৫ বছর মেয়াদকালে উল্লেখযোগ্য ফলাফলের মধ্যে রয়েছে নুরেমবার্গে জার্মানির বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র করা। কাউনাসে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১-০ জয়, এবং নেপলসে ইতালির বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র। তিনটি ম্যাচই হয়েছিল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ২০০৪ বাছাইপর্বের সময়। এ ছাড়া লিউবিন্সকাস ইউক্রেন, কাজাখস্তান, পোল্যান্ডে কোচ হিসেবে কাজ করেছেন । লিথুয়ানিয়াতে, এফ কে কারেদার সঙ্গে, জাতীয় কাপ, সুপার কাপ জিতেছেন এবং চ্যাম্পিয়ন করেছেন ।  

এত সব বিশ্বমানের ফুটবলের আবহে বিরাজমান থাকা অবস্থাই থেকেও আবাহনী ক্লাবে বাংলাদেশে থাকা সময়টার কথা তার তার সব সময়ই মনে পড়ে এখনও পড়ন্ত বেলায় তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ।

লিউবিন্সকাসের গল্পের যেন শেষ নাই। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার তার মতো বিশ্বমানের কোচকে আমরা আর কখনো স্মরণ করি নাই । নিম্নমানের অনেক কোচের পেছনে আমরা কাড়ি কাড়ি ডলার নষ্টও করলেও বিশ্বমানের কোচ লিউবিন্সকাসের কথা কখনো মনে করি নাই। লিউবিন্সকাস আরও কিছিদিন বাংলাদেশে থাকলে আবাহনী যেমন লীগে আরও ভালো করত, তেমনই মুন্নার মতো আরও কিংবদন্তি আমরা পেতাম।  

এত সব বিশ্বমানের ফুটবলের আবহে বিরাজমান থাকা অবস্থা থেকেও আবাহনী ক্লাবে বাংলাদেশে থাকা সময়টার কথা সব সময়ই মনে পড়ে লিউবিন্সকাসের, এখনো পড়ন্ত বেলায় তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে তার কোচিং জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র টিভিতে দেখানো হয়েছে। বর্তমানে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন না, তবে এখন তিনি লিথুয়ানিয়ান কোচ কাউন্সিলের ডেপুটি। তার বড় ছেলে তার পথে অনুসরণ করে এবং তরুণ ফুটবল খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তার চার সন্তান, দুই মেয়ে ও দুই ছেলে, তিন নাতি ও এক নাতি নিয়ে তার সুখের সংসার।