তীব্র গ্যাস সংকটে বিপাকে বাণিজ্য

আব্দুল্লাহ কাফি ও রেজাউল রেজা
২২ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
তীব্র গ্যাস সংকটে বিপাকে বাণিজ্য

চলমান গ্যাস সংকটে দেশের ছোট-বড় প্রায় সব শিল্প কারখানাতেই উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে বেড়ে গেছে উৎপাদন ব্যয়। শুধু তা-ই নয়। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পে বাতিল হচ্ছে ক্রয়াদেশ। উপরন্তু কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শঙ্কা বাড়ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে বড় বড় শিল্প কারখানাই নাজেহাল। আর টিকে থাকার যুদ্ধে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা। সব মিলিয়ে পুরো বাণিজ্য খাতই রয়েছে ভীষণ বিপাকে। শিগগিরই উদ্ভূত পরিস্থিতির উত্তরণ না ঘটলে দেশের পুরো অর্থনীতিই যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে নানারকম চাপের মুখে রয়েছে। ডলারের বাড়তি দাম ও সংকট এবং কড়াকড়ি আরোপে কমেছে আমদানি। শিল্পের অনেক খাতেই কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি সংকটও দেখা দিয়েছে। তাছাড়া উচ্চমূল্যস্ফীতির সঙ্গেও লড়াই করতে হচ্ছে কারখানাগুলোর। এসবের মধ্যেই গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে গ্যাসের সংকট।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, গ্যাস সংকটে লোকাল সাপ্লাই ব্যাহত হচ্ছে। ফলে আমাদের যে বিপুল পরিমাণে কাপড় প্রয়োজন সেটা মেটাতে আমাদের আমদানি করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব না। এলপিজির যে দাম এখন তাতে বাইরে থেকে গ্যাস কিনে কতদিন আর চালানো সম্ভব? এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে শিল্প কারখানাগুলো শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ কর্মসংস্থানেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, লাগাতার গ্যাস সংকটের ফলে কারখানাগুলোতে উৎপাদনের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে কাঁচামালের অপচয় বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে দিনের বেশিরভাগ সময়ই গ্যাসের চাপ চাহিদা অনুযায়ী না থাকায় বাড়ছে জ্বালানি ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ। অতিরিক্ত এ ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে না পেরে ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানার অনেক উদ্যোক্তা তাদের কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে বেশি দামে হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চান শিল্প উদ্যোক্তারা।

নিট পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না পাওয়ায় কারখানাগুলো প্রায় অচল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে যেসব কারখানা তিতাসের সংযোগে চলছে সেগুলোর উৎপাদন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমেছে। আর যারা বাইরে থেকে কিনে চলছেন, তাদের উৎপাদন ২০ শতাংশের মতো।

রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জের নিট পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উইজডম অ্যাটেয়ার্স। কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মো. আখতার হোসেন অপূর্বের সঙ্গে। তিনি জানান, তাদের কারখানার উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে।

বিকেএমইএর ২০২১-২৩ পরিচালনা পর্ষদের এই সহসভাপতি বলেন, গত প্রায় তিন মাস ধরেই গ্যাসের সমস্যায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে মাসে যেখানে দেড় কোটি টাকা খরচ হতো কারখানা সচল রাখতে, এখন সেখানে অতিরিক্ত দুই কোটি টাকা যোগ হচ্ছে। এত খরচ করে অতিরিক্ত গ্যাস কিনে কারখানা চালানো যায় না। খরচ বাড়ায় আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি। অর্ডার ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে আমদানিনির্ভর হতে হবে। এতে আমাদের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট-এর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, গ্যাসবিভ্রাটে উৎপাদন কমার পাশাপাশি পণ্যের জাহাজীকরণও বিলম্ব হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে বাতিলও হচ্ছে। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে, ক্রেতা হারাতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, উৎপাদন চেইন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন ধরে রাখতে ওভারটাইম করাতে হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শিল্পোদ্যোক্তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। একটু বেশি দামে হলেও তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চান। নইলে কারখানাগুলোতে যেভাবে উৎপাদন কমছে তাতে সরবরাহ চেইন বিঘিœত হচ্ছে। এতে দেশীয় বাজারে পণ্য সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) হিসাব অনুযায়ী, দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলেও সংকট বড় হয় না। কিন্তু তা-ও পাওয়া যায় না। দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এলএনজি আনা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাই এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ।

দিনভর গ্যাস প্রায় না থাকায় উৎপাদন অনেকটাই বন্ধ রয়েছে ফরিদাবাদের কনিকা রি-রোলিং মিল কারখানায়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যপস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী নুর আমাদের সময়কে বলেন, রাতে সামান্য গ্যাস পেলেও সারাদিন গ্যাসের চাপ এতটাই কম থাকে যে, কারখানা চালানো যাচ্ছে না। বর্তমানে দিনের বেলা চুল্লিতে প্রয়োজনের চেয়ে গ্যাসের চাপ অনেক কম। এতে উৎপাদন প্রায় শতভাগই বন্ধ রয়েছে।

রাজধানীর কদমতলী এলাকার টিনের কৌটা ও কনটেইনার তৈরির ছোট প্রতিষ্ঠান ‘ভুইয়া মেটাল’। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় কারখানাটির উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে এবং খরচ দেড়গুণ বেড়েছে বলে জানান কারখানা মালিক মো. ফারুক ভুইয়া। তিনি বলেন, সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ একেবারেই থাকে না। দিনের অর্ধেকেরও বেশি সময় ওভেনের কাজ বন্ধ থাকে। এতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছি না। বাড়তি দামের সিলিন্ডার কিনে মেশিন চালাতে ৫০ শতাংশ বেশি খরচ করতে হচ্ছে। আমাদের পুঁজি কম। ব্যবসায় লোকসান দিয়ে এত খরচ কতদিন আর সামাল দেওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, বাসাবাড়ি আর শিল্প কারখানাগুলো এক কাতারে ফেলে হিসাব করলে হবে না। কারখানায় গ্যাস নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করা না হলে তা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। আর আমাদের মতো ছোট কারখানাগুলোতে তালা ঝুলবে। এতে কর্মসংস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি আমাদের সময়কে বলেন, শিল্প কারখানাগুলোতে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান নির্ভর করে। সুতরাং শিল্প কারখানাগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পমালিকদের এটাও লক্ষ রাখতে হবে, এমন সময়ে শ্রমিকরা যেন কর্মচ্যুত না হন, শেষে যোগ করেন এই শ্রমিকনেতা।