বিদ্যুৎ উৎপাদনেও টান
চলমান গ্যাস সংকটে শিল্প খাতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ, বাসাবাড়িতে জ¦লছে না চুলা, সিএনজি স্টেশনগুলোতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। গ্যাসের সবচেয়ে বড় গ্রাহক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতেও ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ফলে এই শীতেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্যাসের এই সংকট যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের লোডশেডিং ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা অবশ্য বলছেন, আসন্ন সেচ মৌসুমে ও গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ভোগান্তি যেন কম হয়, সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সক্ষমতা তার ৪৫ দশমিক ১২ শতাংশই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। সরকারি হিসাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৯৫১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১১ হাজার ৭০৮ মেগাওয়াটই গ্যাসভিত্তিক। অথচ গ্যাস সংকটের কারণে গতকাল রবিবার বিকাল ৫টায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৯৪৬ মেগাওয়াট; গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার মাত্র ২৭ শতাংশ উৎপাদন করছে, ৭৩ শতাংশই বন্ধ থাকছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রের খবর, প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও সারা বছরই গ্যাসের অভাবে প্রায় অর্ধেক কেন্দ্রই বন্ধ থাকে। সর্বোচ্চ ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ভুল পরিকল্পনার কারণে গ্যাস না থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাড়ানো হয়েছে। অথচ সারা বছরই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই বন্ধ অথবা সংস্কার কাজে থাকে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার সকাল ১০টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯ হাজার ১শ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন ছিল ৮ হাজার ৬৩০ মেগাওয়াট। সারাদেশে প্রায় ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি বা লোডশেডিং ছিল। এ ছাড়া গতকাল রবিবার দুপুর ১টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আর উৎপাদন ছিল ৯ হাজার ৩৬ মেগাওয়াট।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পিডিবির এক সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, কাগজে-কলমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৯৫১ মেগাওয়াট হলেও মূলত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। আর গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২ হাজার মেগাওয়াট। শীতকালে গড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট। তবে গত কয়েক দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মূলত গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায়। এ কর্মকর্তা বলেন, আসন্ন গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ চাহিদা সর্বোচ্চ ১৭ হাজার নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ ঠিকমতো করতে না পারলে এবার সংকট দেখা দিতে পারে।
বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রণালয়ও ফেসবুক বার্তায় জানিয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিতে পারে। বার্তায় আরও বলা হয়, কারিগরি ত্রুটির কারণে মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের কিছু কিছু এলাকাতে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতে পারে। গ্রাহকদের অনাকাক্সিক্ষত অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে বিদ্যুৎ সংকটের খবর আসছে। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা রয়েছে ৫ হাজার ৪১২ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬ হাজার ৪৯২ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের ২৫ দশমিক ০২ শতাংশ। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৪৯০ শতাংশ, যা মোট উৎপাদনের ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আমদানিকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ ১১৬০ মেগাওয়াট, যা মোট চাহিদা বা উৎপাদন সক্ষমতার ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পিডিবির ওয়েবসাইট থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রকৃত অর্থে আমদানিকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ২৬৬০ মেগাওয়াট। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে এ বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এ ছাড়া হাইড্রো বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৩০ মেগাওয়াট, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ, সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪৫৯ মেগাওয়াট, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা এফএসআরইউ সংস্কারের কাজের জন্য গ্যাসের সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাসের উত্তোলন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি অর্থ সংস্থানের ওপর নির্ভর করে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন