আমদানি ও রপ্তানিতে বাড়ছে সময়-ব্যয়
লোহিত সাগরে উত্তেজনা
লোহিত সাগরে হুথি গোষ্ঠীর একের পর এক জাহাজ হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে উদ্বেগ। গুরুত্বপূর্ণ এ রুটে হঠাৎ এমন উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপত্তি ঘটছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও এর আঁচ লাগতে শুরু করেছে। জানা গেছে, ঝুঁকি এড়াতে বিশ্বের বড় বড় জাহাজ কোম্পানিগুলো বর্তমানে এ রুট পরিবর্তন করে ভিন্ন রুট ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে সময় বেশি লাগছে, বেড়ে যাচ্ছে ব্যয়ও। সঙ্গত কারণেই বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন দেশের ব্যবসায়ীরা।
লোহিত সাগর হচ্ছে পণ্য পরিবহনে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যকার ১২০ মাইল দীর্ঘ সুয়েজ খাল আফ্রিকাকে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া থেকে পৃথক করেছে। এটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট পথ। বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ ও কনটেইনার ট্রাফিকের প্রায় ৩০ শতাংশ এ পথ দিয়েই হয়ে থাকে। কিন্তু গত বছরের নভেম্বর থেকে এ রুটের লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে একের পর এক হামলা চালাচ্ছে ইরান সমর্থিত হুথি গোষ্ঠী। গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদ ও গাজাবাসীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এসব হামলা চালাচ্ছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজারে উদ্বেগ বাড়ছে।
জানা গেছে, সুয়েজ চ্যানেল ব্যবহার করতে না পারায় বর্তমানে বাংলাদেশ-ইউরোপ রুটে ২২ দিন অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। এতে জাহাজ ভাড়া খরচ প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত ব্যয়ের চেয়েও ভয়াবহ হলো অতিরিক্ত ২২ দিন সময়ক্ষেপণ। কারণ এতে পণ্যবাহী বড় জাহাজের (মাদার ভেসেল) শিডিউলে বিপর্যয় ঘটছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন আমাদের সময়কে বলেন, সুয়েজ খাল ব্যবহার করে এ অঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। বর্তমানে ভিন্ন রুট ঘুরে আসার কারণে জাহাজের ভাড়া ও সময় বেড়ে গেছে। লোকসান কমাতে জাহাজ মালিকরা এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ সারচার্জ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ পরিস্থিতি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
দেশের আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এ উত্তেজনার মধ্যে জাহাজভাড়া বেড়ে গেছে। রুট পরিবর্তনের কারণে জাহাজের জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। এরই মধ্যে কনটেইনার ভাড়া ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাড়তি খরচের চাপ পড়বে পণ্যের দামেও। বড় সমস্যা হচ্ছে, কাক্সিক্ষত সময়ে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আগামীতে কনটেইনার সংকটও দেখা দিতে পারে।
দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্পে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানান বিজিএমইএর পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোতে তৈরি পোশাকের রপ্তানি সবচেয়ে বেশি। লোহিত সাগর রুট হয়ে এতদিন রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু লোহিত সাগরের চলমান উত্তেজনার প্রভাবে এরই মধ্যে জাহাজভাড়া বেড়ে গেছে। কনটেইনার ভাড়া ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। রপ্তানিতে খরচও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের পোশাক ক্রেতারা বিষয়টি কীভাবে নিচ্ছে সেটার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। এ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীরাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এটা দীর্ঘায়িত হলে কনটেইনার সংকটও দেখা দিতে পারে। যেটা করোনাকালেও ঘটেছে।
এরই মধ্যে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বেড়ে গেছে বলে জানান দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি খায়রুল হুদা চপল। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আমদানিতে আমাদের যেখানে ৬০০ ডলার খরচ হতো, সেখানে এখন ৩০০০ ডলার হয়ে গেছে। এমনটা চলতে থাকলে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সার্বিক ব্যবসায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ জুটপণ্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এস আহমেদ মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, এমনিতেই পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ধুঁকছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতাও অনেক। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে টিকে থাকতে বেগ পেতে হচ্ছে। লোহিত সাগরের উত্তেজনায় ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে পণ্য পাঠাতে জাহাজ ভাড়াসহ রপ্তানি ব্যয় বেড়েছে। এতে বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে আমাদের। আফ্রিকার দেশগুলোতে পণ্য পাঠাতে এ রুট ব্যবহার হয় না। কিন্তু সেখানেও জাহাজ ভাড়া বাড়ছে।
তবে দেশের অর্থনীতিতে লোহিত সাগরের চলমান সংকটের প্রভাব এখনও পড়েনি বলে জানান বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও ডলারের মূল্য এবং সুদহার- এ তিন সূচকের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাপক প্রভাব না পড়লেও সামান্য প্রভাব হয়তো পড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি তেলের দাম পড়তির দিকে থাকলেও বর্তমানে থেমে গেছে। ডলারের ইনডেক্সও কমার দিকে ছিল, সেটা এখন একটু বাড়তির দিকে। তবে সুদহারে তেমন পরিবর্তন নেই। অর্থাৎ লোহিত সাগরে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রভাব এখনও সেভাবে পড়েনি। তবে বোঝা মুশকিল পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে তা বাংলাদেশে আমদানি ও রপ্তানি দুটোতেই বড় প্রভাব ফেলবে।
তিনি আরও বলেন, এর প্রথম প্রভাবটা পড়বে রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের ওপর। জাহাজ ব্যয় বাড়লে ক্রেতারা তখন নিকটবর্তী উৎসগুলোর দিকে ঝুঁকবে। সেক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়তে পারি। রপ্তানিতে ব্যয় বাড়লে আমাদের পাশের প্রতিযোগী দেশগুলোও একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবে। তবে আমাদের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের সংকট মোকাবিলা করা তুলনামূলক কঠিন হবে। তাছাড়া আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যমূল্যেও প্রভাব পড়বে। আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়লে তা ভোক্তার কাঁধে গিয়েই পড়বে। সামনে রমজান মাস। এর সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ ব্যবসাও করতে পারে। তাই আমাদের সেদিকেও নজর রাখতে হবে যাতে পণ্যবাজারে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি না ঘটে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটে এমনিতেই দেশে পণ্য আমদানি কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে লোহিত সাগরের উত্তেজনা। বর্তমানে পণ্য আমদানিতে কতটা প্রভাব পড়েছে জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের পণ্যগুলো আমদানিতে এখনো সেভাবে সমস্যায় পড়তে হয়নি। তবে সামনে পড়তে হতে পারে। আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। এরই মধ্যে আমাদের গমের একটা চালান আটকে আছে। পরিস্থিতির স্থায়িত্ব বেশিদিন হলে সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ আমদানি খরচ বেড়ে যাবে আমাদের।