‘দাফনের’ ৭ মাস পর স্বামীসহ বাড়ি ফিরলেন ববি, অতঃপর...

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
২০ জানুয়ারী ২০২৪, ১৯:৫৮
শেয়ার :
‘দাফনের’ ৭ মাস পর স্বামীসহ বাড়ি ফিরলেন ববি, অতঃপর...

মরদেহ পাওয়া গেছে। শনাক্তের পর দাফনও করা হয়েছে। মৃত নারীকে হত্যার দায়ে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তি জেলহাজতও খেটেছেন ৪০ দিন। এরই মধ্যে সাত মাস পর গত বুধবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসেছেন ২৭ বছর বয়সী সেই তরুণী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের চৌকার গ্রামের এই তরুণী ববি খাতুনের সঙ্গে আরও এসেছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার মাজেদ আলী। ববি খাতুন জানিয়েছেন, ‘নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার মাজেদ আলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে।’ 

‘মৃত ব্যক্তি’ ফিরে আসার ঘটনায় চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে শিবগঞ্জজুড়ে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ‘বস্তাবন্দি মরদেহটি তাহলে কার ছিল?’

জানা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে বাসা থেকে নিখোঁজ হন ববি। এ ঘটনায় গত ২১ জুলাই ববির সাবেক স্বামী রুবেলকে দায়ী করে শিবগঞ্জ থানায় নিখোঁজের জিডি করে ববির পরিবার। কয়েকদিন পর ২৬ জুলাই দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের লিলিখিলি মোড়ের একটি পুকুরে বস্তাবন্দি অর্ধগলিত অজ্ঞাত নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ববির পরিবার সেই নারীকে নিজেদের মেয়ে দাবি করলে; ডিএনএ টেস্টের জন্য স্যাম্পল সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। অথচ ডিএনএ রিপোর্ট এখনো না আসলেও; অধিকতর তদন্ত ছাড়াই পুলিশ সন্দেহজনক আসামি হিসেবে রুবেলকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে।

অপরদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৬ জুলাই দুপুরে লিলিখিলি মোড়ের একটি পুকুর থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মৃত এই নারীর গায়ে থাকা স্বর্ণালংকার দেখে ববির পরিবার তাকে ‘ববি’ হিসেবে চিহ্নিত করে। পুলিশের উপস্থিতিতে জেলা শহরের ফকিরপাড়া গোরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় সদর থানা পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

এ মামলায় শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের ক্যাপড়াটোলার এনামুল হকের ছেলে রুবেল আলীকে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে। তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। ৪০ দিন পর জেলহাজত থেকে জামিনে মুক্ত হন রুবেল। তবে মামলাটি এখনও চলমান। এ মামলায় পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে ফাহিম ও বিপ্লব নামে আরও দুইজনকে আটক করেছিল। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। 

এ বিষয়ে মামলার অভিযুক্ত আসামি ও ববির সাবেক স্বামী রুবেল বলেন, ‘ববি নিখোঁজ হওয়ার পরে অভিযোগ করা হয়, আমি নাকি গুম করেছি। তিনদিন পরে সদর উপজেলার একটি পুকুর থেকে বস্তাবন্দী অজ্ঞাতপরিচয়ের এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহটি ববির বলে শনাক্ত করে তার পরিবার। পরে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ৪০ দিন জেল হাজতে থাকার পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছি। কিন্তু মামলা এখনো চলছে। আমি কোনো অপরাধ না করেও এতদিন জেল হাজতে থাকতে হয়েছে। অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। এই খবরে স্বস্তি পেয়েছি। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।’

রুবেলের বাবা মো. এনামুল হক বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার ছেলেকে ববির পরিবার ও পুলিশ ফাঁসিয়েছে। এখন মেয়েটি জীবিত হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। আমি যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ও আমার ছেলেকে পুলিশ নির্যাতন করেছে। সেগুলোর সঠিক তদন্ত করে জড়িতদের সকলের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। আমার ছেলের মতো আর কারো ছেলে যেন এমন ঘটনার স্বীকার না হয়।’ তবে এ বিষয়ে কথা বলতে ববির পরিবারের কেউ রাজি না হলেও; উল্টো রুবেলের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন জীবিত ফিরে আসা ববি বেগম। ববি খাতুন দাবি করেছেন, রুবেল আলী ও তার সহযোগীরা তাকে বাড়ি থেকে মোবাইল ফোনে মনাকষা এলাকায় ডেকে নিয়ে যান। তারপর গোমস্তাপুর উপজেলায় নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালান। পরে তারা ববি খাতুনকে নওগাঁ জেলায় ফেলে পালিয়ে যান। অচেতন অবস্থায় তাকে এলাকাবাসী উদ্ধার করেছে। এ সময় পরিচয় হয় নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার মাজেদ আলী নামের এক যুবকের সঙ্গে। একপর্যায়ে তারা বিয়ে করেন। গত ছয় মাস ধরে তারা ঢাকায় বসবাস করছিলেন।

এতোদিন বাড়িতে কেন যোগাযোগ করেননি ববিকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বিনোদপুর ইউনিয়নের ওয়ার্ড সদস্য মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘ববি অনেক দিন পরে বাড়িতে ফিরেছে। তার পরিবার এতদিন দাবি করেছিল, সে মারা গেছে। তাহলে তদন্ত ছাড়াই কিভাবে জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে হত্যা মামলায় একজন নিরপরাধকে জড়ানো হলো, এলাকাবাসী হিসেবে আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই।’

এ হত্যা মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আফজাল হোসেন এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি না হলেও; রুবেলকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেন সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিন্টু রহমান। তিনি জানান, ববিকে উদ্দেশ্য করে নয়; বরং সন্দেহজনক আসামি হিসেবে পুলিশ রুবেলকে গ্রেপ্তার করে। 

এখন প্রশ্ন উঠেছে, বস্তাবন্দী অর্ধগলিত অজ্ঞাত নারীর পরিচয় এবং এই তার হত্যাকারী কে?

পুলিশ বলছে, ৬ মাস আগে বস্তাবন্দী নারীর মরদেহের পরিচয় শনাক্তে এবং হত্যার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে পুলিশ নতুন করে কাজ শুরু করেছে।