সংকট বড় হচ্ছে জ্বালানিতে
দেশের জ্বালানি খাত বর্তমানে নানামুখী সংকটে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানি দ্রব্যের নির্ভরযোগ্য জোগান না থাকার কারণে ক্রমান্বয়ে জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। সরকারের ধারণা অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাসের সন্ধান না মিললে আরও বেশি পরিমাণ জ্বালানি দ্রব্য আমদানি করতে হবে। জ্বালানি দ্রব্য (গ্যাস, কয়লা, জ্বালানি তেল ইত্যাদি) আমদানি করতে গিয়ে সরকার বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়ছে। নানা দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। ডলারের দাম ওঠানামার কারণে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। অন্যদিকে আমদানির ওপর বেশি নির্ভর করায় গত কয়েক বছর ধরে আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিভিন্ন সরবরাহকারী সরকারের কাছে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে। এ ছাড়া সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর ওপর প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি ও সরবরাহের চাপ রয়েছে। ফলে শিগগিরই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে জ্বালানি দ্রব্য আমদানিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে জানা গেছে। তবে দায়িত্বশীল কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন- জ্বালানি দ্রব্য বিশেষ করে গ্যাসের সরবরাহে কিছুটা উন্নতি ঘটান গেলেও গ্রাহকের প্রত্যাশা অনুযায়ী জ্বালানির সরবরাহ মিলবে না শিগগিরই। সেটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে সরকার।
চলতি বছরের শুরু থেকেই গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। শিল্পকারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আবাসিক বাসভবনেও গ্যাস থাকছে না। এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, শীতের সময়ে গ্যাসের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানিও কমেছে। অথচ প্রতিনিয়তই গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। ফলে গ্যাস সংকট বেড়েই চলেছে। পেট্রোবাংলা বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির আমদানি কমার সঙ্গে অন্যান্য খাত থেকেও গ্যাস সরবরাহ কমেছে। এতে করে শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাস সংকটে ভুগছেন। চড়া দামে বিকল্প জ্বালানি কিনে উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পের মালিকরা। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ভালুকা, শ্রীপুর, মুন্সীগঞ্জের দিকে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলো চরম গ্যাস সংকটের মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সর্বোচ্চ সরবরাহ ২৭শ মিলিয়ন ঘনফুট। সারাদেশে চাহিদার তুলনায় ঘাটতি প্রায় ১৩শ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে সামগ্রিক গ্যাস সংকটে রয়েছে দেশের শিল্প খাত। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ মিলছে না প্রায় এক দশক ধরে। সার কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানা- সবখানে রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গ্যাস সংকটের কথা তুলে নিট শিল্প ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যারস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি সেলিম ওসমান গত নভেম্বরে সরকারকে চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি সরকারকে জানান, গ্যাসের সংকটে শিল্পকারখানাগুলো সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম পরিচালনা করা হয়। দেশের প্রধানতম রপ্তানি খাত নিট শিল্প ক্রান্তিকাল পার করছে। এসব শিল্পকারখানায় প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক সরাসরি কাজ করেন। পরোক্ষভাবে কাজ করেন আরও ৭০ হাজার। গ্যাস সংকটে তারা সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা সীমিত হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্যাস ও ডিজেলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক কারখানায় শিল্প পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিল্পকারখানা ছাড়াও আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাসের সংকটে আছেন। রাজধানী ও আশপাশের জেলায় এ সংকট প্রকট। দিনে মাঝেমধ্যে গ্যাস পাওয়া যায়। অধিকাংশ সময়ই থাকে না।
সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের অভাব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও গ্যাস মিলছে না গাড়িতে। আবার কোথাও গ্যাস মিললেও প্রত্যাশা অনুযায়ী পাওয়া যায় না। সিএনজি স্টেশন মালিকদের সংগঠন সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারহান নূর আমাদের সময়কে বলেন, যে চাপে স্টেশনগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ থাকার কথা সেটি নেই। ধরুণ ৫/৭ পিএসআই চাপে গ্যাস থাকা দরকার, সেখানে এক পিএসআই চাপে গ্যাস মিলছে। পাইপলাইনে না থাকলে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে অভ্যন্তরীণ গ্যাস উত্তোলন ছাড়াও সরবরাহ বাড়াতে সরকারকে এলএনজি আমদানি করতে হয়, জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, কয়লা আমদানি করতে হয়। সব ক্ষেত্রেই আর্থিক সংকট রয়েছে। কবে নাগাদ এ সংকট মিটতে পারে- সে বিষয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা এফএসআরইউ সংস্কারের কাজের জন্য গ্যাসের সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের জন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে তিনি জানান।
নসরুল হামিদ বলেন, বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে আগামী তিন বছরের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের খসড়া পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেটা নিয়ে কাজ চলছে। গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, দেশীয় কূপ খননে গতিশীলতা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাসের উত্তোলন ছাড়াও সরকারকে বিদেশ থেকে এলএনজি, জ্বালানি তেল, কয়লা আমদানি করতে হয়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক নানা সংকটের প্রভাব পড়ে এর ওপর। কোভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক আর্থিক লোকসান দিতে হয়েছে সরকারকে। বেশি দামে জ্বালানি দ্রব্য আমদানি করতে হয়েছে। সাম্প্রতিক গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটার জন্য জ্বালানি তেল আমদানি প্রভাবিত হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জ্বালানি দ্রব্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের অর্থ সংস্থান এবং বৈশ্বিক সংকটকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন নসরুল হামিদ।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
কাতার, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কয়েকটি কোম্পানি থেকে দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে সরকার। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে এলএনজি আমদানিও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করা হয়। প্রয়োজন সাপেক্ষে স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা হয় এলএনজি। শিডিউল অনুযায়ী এলএনজি ও জ্বালানি তেলের জাহাজ না আসতে পারলেই দেশে সংকট তৈরি হয়ে যায়।
সংকট সমাধানে সময় দেওয়া যাবে কিনা- এ প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের টাইমলাইন ঠিক করা হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সাপ্লাই থাকবে। এখন মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। ৮০ শতাংশই নিজস্ব গ্যাস। আগামীতে গ্যাসের আমদানি না বাড়ানোর চিন্তাই রয়েছে। মাঝখানের গ্যাপ পূরণ করা হবে আমদানির গ্যাস দিয়ে।