ব্যবসায় প্রধান সমস্যা দুর্নীতি

সিপিডির উদ্যোক্তা জরিপ

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ব্যবসায় প্রধান সমস্যা দুর্নীতি

দেশে ব্যবসায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা দুর্নীতি। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অস্থিতিশীলতা, অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ প্রশাসন, বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকট, উচ্চমূল্যস্ফীতি দেশের ব্যবসার পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে বিগত সময়ের চেয়ে অবকাঠামো, ঋণসহায়তা প্রাপ্তি এবং অস্থায়ী নীতি সহায়তার বিষয়ে সামান্য কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২৩ : উদ্যোক্তা জরিপে’ এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির সিপিডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে জরিপটি করেছে সিপিডি। মূলত ২০২৩ সালে ব্যবসায় পরিবেশ কেমন ছিল, সেটি বিশ্লেষণ করার জন্য এই জরিপ করা হয়। গত বছরের মে-জুলাই সময়ে ঢাকা, গাজীপুর ও সাভারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৭১ শীর্ষ কর্মকর্তার মতামত নেওয়া হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সহায়তায় এ জরিপ করা হয়। এ ছাড়া ডব্লিউইএফের ফিউচার অব গ্রোথ রিপোর্ট ২০২৩-এর বাংলাদেশ অংশের জন্য সিপিডি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে।

জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ব্যবসার পরিবেশের অবনতি হয়েছে। প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে বড় ব্যবসায়ীদের শতভাগ, মাঝারি ব্যবসায়ীদের ৬১ শতাংশ এবং ৫৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার ছোট ছোট সরকারি সেবার ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমস্যায় পড়ছেন, যেখানে বড় ব্যবসায়ীদের সমস্যা এসব ক্ষেত্রে কিছুটা কম।

সিপিডি বলছে, গত বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অস্থিতিশীলতা বড় ব্যবসায়ীদের বেশি প্রভাবিত করেছে। ৬২ শতাংশ বড় ব্যবসায়ীদের জন্য এ বিষয়টি প্রতিবন্ধকতা ছিল, যেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিল ৩৮ শতাংশ। রিজার্ভের কারণে বড় ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে এ সময়।

মোটাদাগে ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭ সমস্যা চিহ্নিত করেছে সিপিডি। এর মধ্যে উচ্চমূল্যস্ফীতি, অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, জটিল কর নীতি, বারবার নীতি পরিবর্তন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব, উদ্ভাবনের সক্ষমতায় ঘাটতি, শ্রমশক্তিতে দুর্বল নৈতিকতা, উচ্চ করহার, জলবায়ু পরিবর্তন, সরকারের অস্থিতিশীলতা, অপরাধ ও চুরি, বিধিনিষেধমূলক শ্রম আইন অন্যতম।

সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, একজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তিনি একটি পরিষেবা সংযোগ নিতে আবেদন করলে তার কাছে যে পরিমাণ ঘুষ চাওয়া হয়েছিল, তা তার পরিকল্পিত বিনিয়োগের সমপরিমাণ। বড় ব্যবসায়ীরা কোনো না কোনোভাবে ঘুষ-দুর্নীতি সামলে নিতে পারলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে এটি বড় সমস্যা।

তিনি আরও বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক শীর্ষ পর্যায়ে সদিচ্ছার প্রতিফলন আছে। নির্বাচনী ইশতেহারেও অঙ্গীকার করা হয়েছে। এর বাস্তবায়ন দরকার।

দেশে ব্যবসায়ীদের চ্যালেঞ্জগুলো পরিবর্তন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আগে যেমন ঋণপ্রাপ্তি ও অবকাঠামোর মতো বিষয় নিয়ে তাদের অধিক চিন্তিত থাকতে হতো, এখন তাদের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি, রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। এতে কিছু ব্যবসায়ীর সক্ষমতাও বেড়েছে, তবে মোটাদাগে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী সমস্যার মধ্যে পড়ছেন। তবে দুর্নীতিসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে সার্বিকভাবে কিন্তু আমাদের গত বছরের উৎপাদন, তার আগের বছরের উৎপাদনের তুলনায় অনেকটা কমেছে। গত বছর ব্যবসায়ীরা ভালো করেছেন, এমন সংখ্যা খুব কম। ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, ডলার সংকটের কারণে তারা পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। ডলার সংকটে অনেকেই কাঁচামাল কিনতে পারেননি।

জরিপে আরও উঠে এসেছে, এশিয়ায় ব্যবসায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশই বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার বিবেচনায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে নেই।

ব্যবসায় আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি জানান, জরিপে ৬৬ দশমিক ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করছেন আগামী দুই বছর জ্বালানি সংকটে ভুগবেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ৫৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করছেন, ব্যাংকিং খাতে নজরদারি ও তদারকির অভাব রয়েছে। অপরদিকে অর্থপাচার একটা ব্যাপক স্তরে রয়েছে। অর্থপাচার ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বারবার বললেও সেটা যথাযথভাবে আমলে নেয়নি সরকার। বৈশ্বিকভাবেই জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে এলএনজি আমদানি বড় সংকট তৈরি করেছে। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত জ্বালানি সংকট নিরসনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রাধান্য দেওয়া।

ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতি করতে সিপিডি ১০টি সুপারিশ করেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ব্যবসায় বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতিতে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের ১০০ দিন, ১ বছর, ৩ বছর ও ৫ বছরের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; ন্যায়পাল কার্যালয় স্থাপন; সীমিত সময়ের জন্য খাতভিত্তিক কিছু কমিশন গঠন, যেমন ব্যাংক, শেয়ারবাজার, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার; একটি সমন্বিত আর্থিক লেনদেন খাত প্রতিষ্ঠা; সরকারি কেনাকাটা ব্যবস্থা আধুনিক করা ইত্যাদি।