মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি
নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর ঘোষণা ।। অর্থের প্রবাহ আরও কমবে, বাড়বে ঋণের সুদ ।। সামষ্টিক অর্থনীতিতে চার চ্যালেঞ্জ দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বাজারে অর্থের জোগান কমিয়ে উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে। সেই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে লাগাম টানা হয়েছে। কমানো হয়েছে রিজার্ভ ও ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রাও। এ ছাড়া টাকা ও ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে শিগগিরই ক্রলিং পেগ নামে নতুন পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এ সময় তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে এই মুদ্রানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমলেও অসুবিধা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলাই হবে তার সরকারের প্রধান লক্ষ্য। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে মন্ত্রীদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করার নির্দেশনা দেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সে কাজের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে নীতি সুদহার। কারণ আইএমএফের পরামর্শে চলতি অর্থবছর থেকে সুদহার টার্গেটিং মুদ্রানীতি প্রণয়ন শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে নতুন মুদ্রানীতিতে বাজারে অর্থের জোগান কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে রিজার্ভ ও ব্যাপক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা না পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রানীতির ওপর একটা উপস্থাপনা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, প্রতিটি দেশই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। যার কারণে সবার প্রবৃদ্ধি কমানো হয়েছে। বাংলাদেশের বেলাও সেটি কমানো হয়। বাংলাদেশ সরকারও জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশ হবে বলে আশা করছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির তীব্রতা সবাই যখন অনুভব করছে, তখন সবাই মূল্যস্ফীতি গুরুত্ব দিয়ে পলিসি রেট আগ্রাসীভাবে বাড়িয়েছে। তবে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক আগ্রাসীভাবে বাড়িয়েছে। তাই আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নামবে বলে আশা করা যায়।
নতুন সরকারের সঙ্গে মুদ্রানীতি কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, নতুন সরকার রাজনৈতিক ১১টি নীতিনির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে একটি ছিল- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। আর ব্যাংক খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি ও সুশাসন নিশ্চিত করা। যার দুটোই নতুন মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কতটুকু সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি অর্থনৈতিক এবং অ-অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখছে। অন্য বিষয়গুলো দেখার বিষয়ে নতুন অর্থমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। আগামী রবিবার এ বিষয়ে তিনি একটি বৈঠক ডেকেছেন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
রিজার্ভের ওপর চাপ কমেছে কিনা এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের চলতি হিসাব সবসময় নেগেটিভ থাকে। আর্থিক হিসাব সবসময় পজিটিভি থাকে। আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত দিয়ে ঘাটতি মেটানো হতো। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় রিজার্ভে যোগ হয় না। রিজার্ভে যোগ হয় আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত হতে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে কড়াকড়ি করা হয়। যার কারণে চলতি হিসাব একটা পর্যায় চলে এসেছে। তবে আর্থিক হিসাব থেকে যে উদ্বৃত্ত আসত সেটি গত অর্থবছর নেগেটিভ হয়ে গেছে। এর কারণ হলো- বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি ছিল। এর কারণে রিজার্ভও চাপে ছিল। তবে আমাদের বড় যেসব দায় রয়েছে, তার অধিকাংশ কমে গেছে। কয়েক মাসের মধ্যে ১০০ বা ২০০ মিলিয়নের মধ্যে নেমে আসবে। আর আর্থিক হিসাব যদি পজিটিভ পর্যায় নিয়ে আসা যায়, তা হলে রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করা যায়।
চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ব্যাংকের গ্রুপের হাতে থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের সংকটময় পরিস্থিতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে গভর্নর বলেন, আমি সচিব ছিলাম, এক বছরের বেশি সময় চাকরি ছিল। এখন গভর্নর হয়েছি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। আমি চাইলে চাকরি ছেড়ে দিতে পারব, আবার সরকার চাইলেও আমাকে সরিয়ে দিতে পারে। তবে চেয়ার হারানোর ভয় নেই, কোনো হুমকিও নেই। ভয় দেখাইয়াও লাভ নেই। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর কাঠামোতে সমস্যা ছিল। সেখানে তারল্য সংকট হয়েছে অন্য কারণে। তাদের সুকুক বন্ড রয়েছে টোটাল ইসলামী ব্যাংকের মাত্র দুই শতাংশ। অন্য ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট ছিল। তবে তাদের বন্ডে বিনিয়োগ থাকায় তারা টাকা পেয়েছে। আর্থিক খাতের দুর্বলতার বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, আমরা আগেই দুর্বল ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করেছিলাম। দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, হবেও না। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। তারা খারাপের দিকে যায়নি, দুর্বলতাও কাটিয়ে উঠবে।
নীতি সুদহার ফের বাড়ল : আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্যে নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে। অন্যদিকে রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি বা এসডিএফ) নিম্নসীমার সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়। তবে নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফের (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে সংকটে পড়া ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে।
কমল সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি : নতুন মুদ্রানীতি ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। চলতি মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১১ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। এর মানে অর্জিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও কম ধরা হয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্য। অন্যদিকে নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ, একই সময় পর্যন্ত চলতি মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩১ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১৮ শতাংশ।
কমে যাবে টাকার প্রবাহ : চলতি মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬ শতাংশ, যা নতুন মুদ্রানীতিতে কমিয়ে নেগেটিভ ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মানে আগামী ছয় মাসে নতুন টাকা ছাপিয়ে কোনো ঋণ বাড়াবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে আগামী জুন পর্যন্ত চলতি মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১০ শতাংশ, যা নতুন মুদ্রানীতিতে কমিয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এর মানে আগামী ছয় মাসে বাজারে টাকার প্রবাহ আরও কমে যাবে।
বাড়তে পারে ব্যাংক ঋণের সুদ : নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার আরও বাড়তে পারে। কারণ নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের খরচ আগের চেয়ে বাড়বে। আর ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়লে ঋণের চাহিদা কমে যায়। আর এ কারণেই নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
সামষ্টিক অর্থনীতিতে চার চ্যালেঞ্জ : আগামীতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা নতুন মুদ্রানীতিতে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো হলো- মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে জ্বালানি তেলের দামে অস্থিরতা; বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া; মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা; বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা এবং খেলাপি ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন বা এনপিএল)।