মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জন সুদহার বাড়িয়েও ব্যর্থ

জিয়াদুল ইসলাম
১৫ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জন সুদহার বাড়িয়েও ব্যর্থ


চলতি অর্থবছরে তিন দফা নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বর থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে। তারপরও মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারিত লক্ষ্যের মধ্যে নামানো যায়নি। গত ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে ১ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া এখনো ডলারের সংকট রয়ে গেছে। ফলে ক্রমাগত অবমূল্যায়ন হচ্ছে টাকার। এতে পণ্যের মূল্য সেভাবে কমানো যাচ্ছে না।

এমন প্রেক্ষাপটে আগামী বুধবার চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল পরিচালনা পর্ষদের সভায় এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। জানা গেছে, এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এ জন্য এর ভঙ্গিমা আগের মতোই সংকোচনমুখী রাখা হচ্ছে।

সাধারণত বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ব্যবহার হয়। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে। আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এই

লক্ষ্য ধরা ছিল ৮ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে শুধু অর্থের প্রবাহই নয়, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও পণ্যের সরবরাহজনিত ঘাটতিও দায়ী। তাই নীতিসুদ বৃদ্ধির সুফল পেতে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো ও পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আজ (গতকাল) বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে মুদ্রানীতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলে বিস্তারিত জানা যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে এবারের মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য চলমান সব ধরনের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব সংকোচনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোও চলমান থাকবে।

গত বছরের ১৮ জুন চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে নীতি সুদহার (রেপো হার) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। রেপো রেট বৃদ্ধি করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ১ জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে একটি সুদহার করিডর ব্যবস্থা চালু করা হয়। নতুন এ ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয় সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট। এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের (১৮২ দিন) ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হয় রেফারেন্স রেট। গত জুলাইতে এই রেট ঠিক করা হয় ৩ শতাংশ। এতে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বেড়ে যায়। কিন্তু এরপরও মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো বাড়তে থাকে। এ পরিস্থিতিতে গত ৪ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় নীতি সুদহার একবারে রেকর্ড ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সুদ ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়। এর ফলে স্মার্ট রেট বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ মার্জিন সুদ যোগ করার সুযোগ পায়। তখন জানানো হয়, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে নীতি সুদ ও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় তৃতীয় দফায় গত ২২ নভেম্বর আবারও নীতি সুদহার আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। একই সঙ্গে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়। এর ফলে স্মার্ট রেট দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারছে। কিন্তু তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর পরও মূল্যস্ফীতি নির্ধারিত লক্ষ্যের মধ্যে নামেনি। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে. মুজেরী বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের সব দেশে পলিসি রেট বাড়ানোর প্রচলন আছে। আমরাও সে পথে হেঁটেছি। তবে আমাদের দেশে শুধু পলিসি রেট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। এখানে একটি গোষ্ঠী বাজারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের অভাব আছে। প্রভাবশালী একটি পক্ষ অনিয়ম করে আর্থিক খাতকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, এর জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা, যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ। সংকটের কারণে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয় বেড়ে তার প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে।